২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:০৫

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান : দেশের আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে এখন কালো মেঘের ঘনঘটা। অমাবশ্যার চাদরে ঢাকা পড়েছে দেশের গোটা অর্থনীতি। জিডিপি আর প্রবৃদ্ধির যতো গল্প শোনানো হচ্ছে বাস্তব অবস্থা ঠিক তার বিপরীত। উন্নয়নের ঘুম পাড়ানি গাণ যতোই শোনানো হোক না কেন, মূলত অর্থনীতি এখন মারাত্মক ভঙ্গুর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। দুর্বৃত্ত আর লুটেরাদের কালো থাবায় বিপর্যস্ত গোটা আর্থিক খাত ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা। বিশেষ ব্যক্তি, কোম্পানী এবং গোষ্ঠীর পেটে চলে যাচ্ছে অধিকাংশ ব্যাংক। একদিকে মন্দ ঋণ, লুটপাট, বায়বীয় কোম্পানীর নামে বিনিয়োগ, বিদেশে অর্থ পাচার অপর দিকে সরকারের দখলনীতির কারণে গোটা অর্থনীতির পর্যুদস্তু অবস্থা। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে এমন বেহাল দশা আর কখনো হয়নি। সরকারি ব্যাংকগুলোতে সরাসরি লুটপাট এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সম্পূর্ণ নিয়মনীতি বহির্ভূতভাবে জোরপূর্বক পরিচালকদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে সরকারের অনুগত লোকদের বসিয়ে ব্যাংক দখলের এক নতুন নিয়ম আবিষ্কার করেছে বর্তমান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারী অবৈধ সরকার। সরকারের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক খলীকুজ্জামান গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীতে এক সেমিনারে খোলামেলাভাবেই বলেছেন, খাল, নদী দখলের মতো ব্যাংকগুলোও দখল হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিনা ভোটের সরকারের অন্যতম সঙ্গী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম গত জুন মাসে জাতীয় সংসদের বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ব্যাংক লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একজন সিনিয়র মন্ত্রী সংসদে বলেছেন, নৌকা দিয়ে সমুদ্র পার হওয়া যায় না। আমিও তাই বলি, যায়া না। তিন-তিনবার আমরা লাঙ্গল দিয়ে আপনাদের সাহায্য করেছি। চাইলে আরো দেয়া হবে। কিন্তু অর্থনীতির তো কোনো উন্নতি হচ্ছে না।’ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষতায় আসার সাথে সাথে সরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারের পছন্দের লোকদের দিয়ে পরিচলানা পর্ষদ গঠন করা হয়। সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত দলীয় লোকদের দিয়ে চলে লুটপাটের ব্যবস্থা। লুটপাট করে খোলসা করে দেয়া হয় বেসিক ব্যাংকের মূলধন। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। নামে- বেনামে বায়বীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ করে লুটপাট করা হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যে দেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকের ফান্ড লুটপাটের এক সপ্তাহ পর বিদেশী গণমাধ্যম মারফত দেশের জনগণ জানতে পারে রিজার্ভ চুরি হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলো মারাত্মক ঝুকির মধ্যে থাকায় মৃতপ্রায় রোগীর মতো অক্সিজেন দিয়ে তাদের বাচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নতুন করে মূলধন জোগান দিতে ২০১৭ সালের জুনে ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। কিন্তু এতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না। গোটা ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাত এখন তলাবিহীন ঝুড়ির মতো অবস্থা। সরকারি ব্যাংকগুলো খোলসা করার পর সরকারের নজর পরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে তারা একে একে দখল করতে থাকে সেরকারি ব্যাংকগুলো।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে দুর্বৃত্তদের কালো থাবা। একের পর এক লুট হতে থাকে সরকারি ব্যাংকের টাকা। অন্যদিকে নিজ দলের লোকদের ব্যাংক মালিক বানিয়ে চলে অর্থ লুটের মহোৎসব। সর্বশেষ বেসরকারি ব্যাংকগুলো দখল করে চলছে লুটের মহা আয়োজন। মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাংকগুলোতে দেখা দিয়েছে আর্থিক সংকট। অর্থনীতিবিদরা বলছেন,ব্যাংকিং খাতে ঘটেছে একের পর এক অস্বাভাবিক বড়ো কেলেঙ্কারি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সরকার এবং জনগণ প্রথমে কিছুই জানে না। বর্তমান বিশ^ ব্যবস্থায় এমন আজব ঘটনা একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। উন্নয়নের ডুগডুগি বাজিয়ে গোটা জাতিকে ঘুম পারিয়ে রেখে সর্বত্র চলছে মহা লুটের আয়োজন। সব কিছু লুটপাট করতে করতে যখন সব শেষ এখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের নজর ব্যাংকগুলোর দিকে। রাতারাতি এক আজব ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। দখলের পর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে সরকারের চেলা-চামুন্ডাদের নামে বেহিসাব বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোকে খোলসা করে ফেলছে। কট্টর আওয়ামীপন্থী লোক হিসেবে পরিচিত আবুল বারাকাত সাহেব এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘ঠিকমতো হিসাব করলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।’ ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে সংগঠনটির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

জনাব বারকাত বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি বড়ো ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ব্যাংকের আর্থিক হিসাবে সমস্যা রয়েছে। ঠিকমতো হিসাবপত্র করলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।
প্রচলিত ব্যাংকিং করার জন্য এখন আর নতুন ব্যাংকের দরকার নেই। বাংলাদেশের বাজারে স্মিতের দ্বিতীয় মত বেশি কাজ করছে। যে কারণে চাল বা পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা যায়। একইভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে নৈতিক বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডের যে ব্যয় বৃদ্ধি পায় তার একটা অংশ অনৈতিকভাবে বাড়ে।’
বারাকাত সাহেব বর্তমান ক্ষমতাসীন মহলের খুব ঘনিষ্টজন বলে পরিচিত। কোনো রাখ-ঢাখ ছাড়াই তার এ বক্তব্য অর্থনীতির সারবত্তা প্রকাশ করেছে। জনাব বারাকাত সাহেব সবচেয়ে বেশী সোচ্চার ছিলেন ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সূদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘মৌলবাদী অর্থনীতি’। এ ব্যাংকিংটির দ্রুত বিকাশমান ধারাকে কিভাবে রোখা যায় তা নিয়ে তিনি প্রায়শই বক্তৃতা বিবৃতি দিতেন। সরকার ইসলামী ব্যাংক দখল করার পর তিনি খুশীই হয়েছিলেন বৈকি। কিন্তু যখন বুঝলেন চোরকে চুরির রাস্তা দেখানোর পর সে শুধু অন্য প্রতিবেশীর বাড়িতেই চুরি করে না, বরং সকল বাড়িতেই চোরের হানা পড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে অর্থনীতিকে ধ্বংসের দাড়প্রান্তে দেখে সরকার সমর্থকরাও মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছেন।

একে একে অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের শিকার হয় ইসলামী ব্যাংক, এস আই বি এল, আল আরাফাহ, আই এফ আই সি, ঢাকা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বরে দখল করা হলো এ বি ব্যাংক। যদিও আজকের আলোচনার বিষয় ব্যাংকিং খাতের দখল, তবে গোটা অর্থনীতি যে এখন তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার উন্নয়নের ডুগডুগি বাজিয়ে যা বোঝাতে চায়- পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। উন্নয়নের যে শ্লোগাণ বার বার শোানো হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে লুটপাট ও দুর্নীতিকে ঢাকা দেয়ার মহা আয়োজন। বর্তমান সরকারের আমলে হাতে গোনা যে কয়টি বড়ো প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে তার একটি হচ্ছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। এটির নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর যে কোনো ফ্লাইওভার নির্মান ব্যয়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশী। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে যখন এটির কাজ উদ্ভোধন করা হয় তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৩৫০ কোটি টাকা। পরে ধাপে ধাপে এ প্রকল্পের ব্যয় ৬ গুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ খরচ হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। অথচ শুরুতে নির্মাণ ব্যয় ধার্য করা হয়েছিল প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। শুরুর তুলনায় প্রতি কিলোমিটারে ১১০ কোটি টাকা বেশি ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। কুড়িল ফ্লাইওভারে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা এবং মিরপুর-বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারের সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায় ভারতের দিল্লিতে ফ্লাইওভার নির্মাণ ক্ষেত্রে। ওই শহরে দুই লেনের ২ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণে ভারত সরকার খরচ করেছে ৪৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। যার প্রতি কিলোমিটারের খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকার চেয়ে একটু বেশি। যে পাকিস্তানের নাম শুনলে আমরা নাক ছিটকাই- তাঁদের পেশোয়ারে ২ দশমিক ১২ কিলোমিটারের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। যার প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬১ কোটি টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়ায় ফ্লাইওভারে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হচ্ছে ৬১ কোটি টাকা করে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ঐ দেশগুলোতে নির্মাণ খরচ কিছুটা কম-বেশি হয়ে থাকে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশে। আমাদেরকে পদ্মা সেতুর গল্প শোনানো হচ্ছে বহুদিন ধরে। অনেক গাল-গল্পের পরে তার একটি পিলার নাকি এখন দৃশ্যমান হয়েছে। এটির নির্মাণ ব্যয় কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে- তা আল্লাহ মালুম।
আমাদের সরকারকে নাকি কোন একটি সংস্থা সর্বোচ্চ তৃতীয় দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে যে আন্তর্জাতিক সাময়িকীটির নাম বলা হয়েছে, সে ম্যাগাজিন এ ধরনের কোনো জরিপ পরিচালনা করে বলে আমাদের জানা নেই। যেখানে পদে পদে দখল, দুর্নীতি আর লুটপাট সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে, সেখানে সুনীতির গালগল্প কতটুকু বিশ^াসযোগ্য তা গল্পের প্রচারকরা আম-জনতার সাথে একটু আলাপ-চারিতায় মিলিত হলে টের পাবেন। এতো উন্নয়নের জোয়ার কিন্তু দেশের রাস্তা-ঘাট,কালভার্ট এবং সেতুর যে কি বেহাল অবস্থা তা যারা সড়ক পথে ভ্রমণ করে তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। গোটা অর্থনীতি আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর্থিক প্রবাহের প্রধান মাধ্যম ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজ ধ্বংস প্রায়। সরকারি দখল নীতির কবলে পড়ে ব্যাংকগুলো সাধারণ গ্রাহকদের ছোটো ছোটো লেন-দেনও সময় মতো করতে পারছে না।

দখল হওয়া ব্যাংকগুলোর অবস্থা মোটেও ভালো নয়। সরকার হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফান্ড ডোনেট করে দখলী স্বত্ব টিকিয়ে রাখবে। কিন্তু যেভাবে হরিলুট চলছে তাতে কতদিন এভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে! তলাবিহীন ঝুড়িতে যতোই মালামাল রাখা হোক না কেন, তা ঝুড়িতে জমা হবে না মোটেও। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষতায় আসার সাথে সাথে সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ দেয় পরিচালনা পর্ষদ। সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত দলীয় লোকদের দিয়ে চলে লুটপাটের ব্যবস্থা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়। যা আর ফেরৎ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
সরকারি বেসিক ব্যাংকের লুটপাট করে তাকে দেউলিয়া করার পর কিছু কর্মকর্তাকে মামলা দিয়ে জেলে আটক করে রাখা হয় দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু লুটপাটের মূল হোতারা ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে যায়। ঋণ বিতরণে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ খেলাপির কারণে ধ্বংসের শেষ সীমায় আছে কৃষি ব্যাংক। যখন যাকে মনে চায় তাকেই ঋণ দিয়ে কৃষি ব্যাংকের প্রতিটি শাখা এখন মন্দ ঋণের দুষ্টচক্রের জালে বন্দী অবস্থায় আছে। অনেকটা বলা যায় অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে কৃষি ব্যাংককে।

গত এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে ব্যাংকটির কলমানি ঋণের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ক্রয়কৃত সরকারি সিকিউরিটিজের (বিল ও বন্ড) পরিমাণ ১ হাজার ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই, বলে একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাংকের যারা উদ্যোক্তা পরিচালক- তারাই লুটপাটের মূল হোতা। লুটপাটকারীরা কেউ বিদেশে পালিয়ে গিয়ে কেউ সরকারের আশ্রয় প্রশ্রয়ে বহাল তবিয়তে আছেন কিন্তু আমানতকারীরা এ ব্যাংকের আমানত ফেরৎ পাবে কি না এখন অনেকেরই প্রশ্ন।

ডিজিটাল স্টাইলে দখল করা হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। সরকারের অস্থাভাজন চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী গ্রুপের দখলে এখন এ ব্যাংক। গত ৩০ অক্টোবর এসআইবিএল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড়ো পরিবর্তন আনা হয়। ওইদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটি চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) হঠাৎ পদত্যাগ করতে হয়েছে। রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ। এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি কাজী ওসমান আলীকে। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন এনআরবি গ্লোাবাল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ। এরা সকলেই সরকারের খুব কাছের এবং আস্থাভাজন লোক। তাঁদের মাধ্যমে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নামে ব্যাপক বিনিয়োগ সুবিধা দিয়ে ব্যাংটির ঝুকিপূর্ণ বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
চরম অনিয়ম অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির মাধ্যমেই মূলত জন্ম নিয়েছে এন আর বি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ব্যাংকটির অবস্থা খতিয়ে দেখতে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হলে তারা তদন্ত শেষে যে রিপোর্ট দেয় তাতে বলা হয় : ব্যাংকটি গঠনের সময় মূলধন সংগ্রহে অনিয়ম, অনিবাসীদের পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তি কর্তৃক ব্যাংকের শেয়ার কেনা, বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদান এবং ব্যাংক হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টির সাথে পরিষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোম্পানি আইনের বিধান এবং ব্যাংকের আর্টিক্যালস অব অ্যাসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট ধারা লঙ্ঘন করে ব্যাংকের একজন পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তার শেয়ার হস্থান্তরের বিষয়ে পরিচালনা পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এছাড়া নিয়ম না মেনে ৬ জন পরিচালকের শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ ও ৩ জন পরিচালককে অপসারণ করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলে তার ফল যে চরম অশুভ হয় এর জলন্ত প্রমাণ এন আর বি কমার্শিয়াল ব্যাংক।
একদিকে ব্যাংক দখল, অন্য দিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিত্য নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে দলীয় ক্যাডারদের ধনকুবের বানানোর যে অশুভ কার্যক্রম চলছে তাতে গোটা অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা লুটেরা, টাউট বাটপার আর দলীয় ক্যাডারদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে। এর আশু পরিণতি কখনো শুভকর হবার কথা নয়। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন আরো কয়েকটি ব্যাংককে নাকি সরকার লাইসেন্স দিচ্ছে। যে ব্যাংক বর্তমানে চালু আছে সেগুলোর ঘাণি টানা যখন কষ্টকর হচ্ছে তার উপরে আবারো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে সরকার আসলে দেশের অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়? ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশে যেখানে অর্ধ শতাধিক ব্যাংক আছে, সেখানে আরো নতুন ব্যাংক কোন স্বার্থে ? এটা অবশ্যই দেশের অর্থনীতি এবং জনগণের স্বার্থে যে নয় তা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা যেমন প্রতিদিন অর্থনীতি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করছেন একইভাবে দেশের জনগণও দেশের অর্থনীতি নিয়ে চরমভাবে শংকিত। জনগণের এ শংকা কাটানোর জন্য বর্তমানে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে বলে মনে হয় না। জনগণের কাছে যাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই তারা এ সংকট কাটাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবে না এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে সকল প্রকার অস্থিরতা, অন্যায়, দুর্নীতি এবং সীমাহীন লুটপাট বন্ধের আগে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ। গণতন্ত্র নামক রেলগাড়িটিকে তার লাইন থেকে বিচ্যুৎ করার কারণেই আজ এ অবস্থা। তাই সর্বাগ্রে দরকার গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তির উপর স্থাপন।
hafizurrahmanbd1978@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/312537http://www.dailysangram.com/post/312537