২২ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৫৫

পরীক্ষামূলক ডিভিএমে ত্রুটি

ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে ব্যর্থ হয়ে রংপুর সিটি নির্বাচনের একটি কেন্দ্রে ডিজিটাল ভোটিং মেশিনের (ডিভিএম) পরীক্ষামূলক ব্যবহার চালায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল ভোটগ্রহণের সময় এই প্রযুক্তি নিয়েও বিপাকে পড়ে নির্বাচন কর্মকর্তারা। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। পরে কোনো প্রতিকার করতে না পেরে ভোটিং প্যাড পরিবর্তন করে ফের ভোটগ্রহণ চালু করা হয়।
২০১৬ সালে ইসি নিজ উদ্যোগে ডিভিএম বানানো তৈরি শুরু করে। রংপুর সিটিতে ইসির তৈরি যন্ত্রটির প্রথম পরীামূলক ব্যবহার হয়। নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪১ নম্বর ভোট কেন্দ্রের ডিভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেয় ইসি কর্মকর্তারা। কিন্তু ভোট শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা পরই ছয়টি বুথের মধ্যে দু’টি বুথে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আজহারুল ইসলাম বলেন, ভোটাররা সঠিকভাবে ভোট না দিতে পারায় আবার মেশিন ভোটগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে না। ফলে কিছুটা ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। আমরা আবার ভোটিং প্যাড পরিবর্তন করে ভোটগ্রহণ চালিয়ে যাচ্ছি।
ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের নেতৃত্বে সিস্টেম এনালিস্ট ফারজানা আক্তার, সিনিয়র মেইনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ হোসেন, এনআইডির সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএস) কর্মকর্তারা ডিভিএম-এ ভোটগ্রহণ তদারকি করছেন। বেগম রোকেয়া কলেজ ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা এনআইডির ডিজি ডিভিএম-এ ত্রুটি থাকার বিষয় স্বীকার করে বলেন, নতুন ডিভিএম-এ কিছু সমস্যা আছে। এই মেশিনে কিছু সময় পরপর বিরতি দিতে হয়। মেশিনের রোল ও প্যাড পরিবর্তন করতে হয়। রংপুরে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ডিভিএম। সাকসেস রেট দেখে পরে কিভাবে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কাজে লাগানো যায় তা বিবেচনা করা হবে।

নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়ে বিদায় হওয়ার পর আবারো আলোচনায় ডিজিটাল ভোটিং মেশিন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সময় ইভিএম বন্ধ হয়ে যায়। তার পরে এটি সারানো আর সম্ভব হয়নি। ফলে ওই কেন্দ্রে আবার ভোটগ্রহণ করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বুয়েটকে একাধিকবার অনুরোধ করা হলেও তারা সমস্যা চিহ্নিত করেনি, বরং ইসি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তোলে বুয়েট। পরে ইসি বুয়েটকে ইভিএম ফেরত দিতে বললেও এখন পর্যন্ত তারা ইভিএম ফেরত দেয়নি। এর পর আবারো আলোচনায় এসেছে ই ভোটিং সিস্টেম।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল, তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করেছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে এক প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছিলেন, আমেরিকায় ইভিএম কারচুপির প্রতিরোধক (টেম্পার প্রুফ) নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কোনো প্রযুক্তি গ্রহণের আগে তার ভালো-মন্দ খতিয়ে দেখা উচিত। আর নির্বাচনের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। যে প্রযুক্তিই গ্রহণ করা হোক না কেন তা রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে করা উচিত।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জে. (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ছোট পরিসরের নির্বাচনে ইভিএম যৌক্তিক। সংসদ নির্বাচনের মতো ক্ষমতা বদলের নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি কমিশন নির্বাচন। কারণ স্বয়ং ইভিএম উদ্ভাবনকারী দেশগুলোও এই প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
ধানের শীষের এজেন্ট সঙ্কট : এ নির্বাচনের পোলিং বুথগুলোতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। বেলা সাড়ে ১১টায় তাজহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় সেখানে সাতটি বুথের মধ্যে তিন বুথেই ধানের শীষের কোনো পোলিং এজেন্ট নেই।
জানতে চাইলে প্রিজাইডিং অফিসার মো: নুরুল হালিম বলেন, এজেন্টকে ধরে নিয়ে এসে বুথে বসানোর দায়িত্ব আমার নয়। আমি সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের জন্য সব ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু এখানে ধানের শীষের এজেন্ট হওয়ার জন্য কেউ আসেনি।

দুপুর ১২টায় তাজহাট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েও পাঁচটি বুথের মধ্যে দু’টি বুথে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট দেখা মেলেনি। জানতে চাইলে প্রিজাইডিং অফিসার শাহজাহান আলী বলেন, আমি চাই সব প্রার্থীর এজেন্ট উপস্থিত থাকুক। কিন্তু ওই দু’টি বুথে ধানের শীষের এজেন্ট হওয়ার জন্য কেউ আসেনি।
এ দিকে সালমা স্কুল ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনকালে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী কাওছার জামান বাবলা অভিযোগ করে সাংবাদিকদের বলেন, ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি সরকারদলীয় লোকজন। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে তার সমর্থকদের হুমকি দিয়ে বের করে দিয়েছে।
তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ভোট কেন্দ্রে সিল ছাড়াই ব্যালট পেপার প্রদান করেন দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসার। এ সময় আমি হাতেনাতে ধরে ফেলে ছবি তুলে জানতে চাই, সিল ছাড়া ব্যালট পেপার কেন? তখন তিনি বলেন, এটি ভুলক্রমে হয়েছে। এ রকম অনেক অসঙ্গতি ও সুক্ষ্ম কারচুপি আশঙ্কা করছি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/278508