২১ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৪

ফারমার্স ব্যাংকে সংকটের প্রভাব পুরো খাতে

ফারমার্স ব্যাংকের শাখায় গিয়ে নিজের জমানো টাকা তুলতে পারছেন না অনেক আমানতকারী। এ ব্যাংকের সংকটের কারণে চাপে পড়েছে পুরো ব্যাংক খাত। নতুন আমানত জোগাড় করতে গিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন ব্যাংকাররা। অনেকেই এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রাখছেন। নতুন ব্যাংকগুলোর সমস্যাই এখন বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ৮৯৯ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়াছে ফারমার্স ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা সমকালকে বলেন, কোনো ব্যাংকে গুরুতর অনিয়ম ঘটার পর যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংক খাতের ওপর তার প্রভাব পড়ে। দু-একটা ব্যাংকে যে সমস্যা হয়েছে, তা সমাধান করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে।

অনেকে ফারমার্স ব্যাংকের সংকটের ঘটনাকে 'ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার উপায়' হিসেবে দেখছেন। এর ফলে শুধু বেশি সুদ পেলেই

সেখানে টাকা না রেখে ব্যাংকের স্থিতিশীলতা ও কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি আমানতকারীরা দেখবেন বলে তাদের ধারণা। তারা মনে করেন, ফারমার্সের নিয়ম না মানার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিয়মকানুন মেনে ব্যাংকিং করছে এ রকম ব্যাংকের প্রতি সাধারণ আমানতকারীদের আস্থা বাড়বে। এ ছাড়া সরকারি ও অন্যসব প্রতিষ্ঠান আমানত রাখার ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ব্যাংকের প্রতি আগ্রহী হবে। এর প্রভাবে সামগ্রিক ব্যাংক খাতে ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, একটি ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্বাভাবিকভাবে অন্য ব্যাংকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রথম থেকেই ফারমার্স ব্যাংকে নানা রকম অব্যবস্থাপনা ছিল। এখন অবস্থা বেশি খারাপ। অনেকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ রকম সময়ে আমানতকারীর আস্থা ধরে রাখার মূল দায়িত্বটা ব্যাংকের। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দ্রুততার সঙ্গে দৃশ্যমান কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে করে আমানতকারীরা মনে করেন, তার অর্থ সুরক্ষিত আছে। পাশাপাশি যেসব ব্যাংকে অনিয়ম রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে হবে। ফারমার্স ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংকগুলো এক ধরনের চাপে রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশার কথা জানান। তিনি বলেন, সঠিকভাবে হিসাব করলে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও সোনালী ব্যাংকের একসময়কার চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক দুর্বলতার কারণে ব্যাংক খাতে একের পর এক অনিয়ম ঘটছে। একদিকে কিছু ব্যাংক আগ্রাসী বিনিয়োগ করছে, যা আর ফেরত আসছে না। অন্যদিকে আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তিনি বলেন, পুরো ব্যাংক খাতে ফারমার্স ব্যাংকের অংশ খুব বেশি নয়। তবে শুধু ফারমার্স ব্যাংক নয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক নিয়েও সম্প্রতি সমস্যা হয়েছে। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, এবি ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনা তো আছেই। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীদের আস্থা কিছুটা ক্ষুণ্ণম্ন হচ্ছে। এটি মোটেও কাম্য নয়।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে ৫৭টি ব্যাংকে বর্তমানে মোট আমানত রয়েছে প্রায় নয় লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এ আমানতের প্রায় ৬৬ শতাংশ রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকে বর্তমানে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে নতুন নয় ব্যাংকে রয়েছে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি নানা সংকটের কারণে অর্থ ফেরত দিতে না পারা ফারমার্স ব্যাংকে আমানত রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানার ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে আমানত রয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান সমকালকে বলেন, কোনো অনিয়ম ঘটলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি।

বেসরকারি খাতের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংকিং চলে আস্থার ওপর। একটি ব্যাংক থেকে অর্থ ফেরত না পেলে তার প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতের ওপর পড়ে। তাদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়।

আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে ৮৯৯ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর পাশাপাশি ৮৯৯ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির পুরো পরিচালনায় পরিবর্তন আসতে পারে। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকটির মোট মূলধন ১৫শ' কোটি টাকায় উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমানে ফারমার্স ব্যাংকের ৪০১ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন রয়েছে।

একটি ব্যাংকের মোট শেয়ারের নূ্যনতম ২ শতাংশ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকলে ওই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক হওয়ার সুযোগ রয়েছে আইনে। জানা গেছে, এখন কেউ এরকম সুযোগ নিতে চাইলে তা দেবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ শেয়ার কিনবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সংশ্নিষ্টদের।

জানতে চাইলে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত সমকালকে বলেন, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংকটি ইমেজ সংকটে পড়েছে। এই সংকট কাটানোর জন্য ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একবার আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া শুরু করা গেলে তখন ব্যাংকটির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরবে বলে আশা করা যায়।

http://samakal.com/economics/article/17121226