২১ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪২

বিভেদের সুযোগে চলছে ইসরাইলের আগ্রাসন

কী জামানা এলো! পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের নেতারা একে অপরকে গালাগাল করছেন। অস্ত্রের ভাষা উদ্ধত, সে কথা আমরা জানি; এ কারণেই কি অস্ত্রের মালিকদের আচরণ এখন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে? চিত্রটা বর্তমান সভ্যতায় এতটাই উৎকট হয়ে উঠেছে যে, কোনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে বিবেকবান মানুষরা এখন মাস্তান বলতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রসঙ্গত মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফিলিস্তিনের পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আন্তর্জাতিক মাস্তান ও খলনায়ক আখ্যা দিয়েছেন তিনি। মাহাথির বলেন, সব ধরনের শক্তি প্রয়োগ করে হলেও অবশ্যই ট্রাম্পকে ঠেকাতে হবে। আজ আমরা একজন আন্তর্জাতিক মাস্তানকে দেখছি। তার সিদ্ধান্ত মুসলিম ক্ষোভকেই কেবল বাড়াবে।

সব মুসলিম দেশকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন মাহাথির। ট্রাম্পকে ঠেকাতে সব ধরনের শক্তি প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মাহাথির এ ধরনের ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত নন। কিন্তু ট্রাম্পের একের পর এক উদ্ধত ও মাস্তানি আচরণ তাঁকে এমন ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করেছে। বিশ্ববাসী জানে, ইসরাইল ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিদের সাথে দীর্ঘকাল ধরে কী নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী আচরণ করে যাচ্ছে। তারপরও সেই ইসরাইলকেই অব্যাহতভাবে সমর্থন ও প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। এখন আবার ফিলিস্তিনিদের পবিত্র শহর জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান এমন পাগলামী করেন কোন কা-জ্ঞানে? মানসিকভাবে অসুস্থ ও মাস্তান মানসিকতার মানুষই হয়তো এমন কাণ্ড করতে পারেন।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্রগুলোও ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধিতা করেছে। এখন আবার পূর্ব-জেরুসালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানিয়েছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লু ক্যাং এ কথা জানান। এএফপি পরিবেশিত খবরে আরো বলা হয়, লু ক্যাং জানান, জেরুসালেম ইস্যুতে তার দেশ মুসলিম বিশ্বের উদ্বেগের বিষয়ে অবগত এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক ঐকমত্য অনুযায়ী জেরুসালেমের মর্যাদা নির্ধারণ সমর্থন করে। চীনের এমন সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল ফিলিস্তিন। এখন দেখার বিষয় হলো, বিশ্ববাসীর সমর্থনের বিপক্ষে ট্রাম্পের মাস্তানি কতটা কার্যকর থাকে। তবে এখানে বলে রাখা ভাল যে, পরাক্রমশালী মাস্তানদের বর্তমান সভ্যতায় শুধু সমর্থন কিংবা সুবচনে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। রোগের নিরাময়ে যেমন উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োজন, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতেও তেমনি প্রয়োজন মোক্ষম দাওয়াই। তেমন দাওয়াই তৈরিতে মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসবে কী?
ফিলিস্তিনের পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতির প্রতিবাদে ইন্তিফাদা বা সর্বাত্মক প্রতিরোধ পালন করছেন ফিলিস্তিনি জনগণ। ১৬ ডিসেম্বর এই ইন্তিফাদার নবম দিন অতিবাহিত হয়েছে। ইন্তিফাদার অষ্টম দিনে (শুক্রবার) ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অন্তত ৩৪০ জন। এ নিয়ে ট্রাম্পের অন্যায় ঘোষণার পর ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে আটজনে দাঁড়িয়েছে।

ফিলিস্তিনি জনগণের ইন্তিফাদা জালেম ইসরাইলি বাহিনীসহ পৃথিবীর আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শুক্রবার ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে আহত ফিলিস্তিনি যুবক ইবরাহিম আবু সুরিয়া মৃত্যুর আগে অন্তিম বাক্যে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এই ভূখ- (জেরুসালেম) আমাদের, আমরা আত্মসমর্পণ করবো না’।
জন্মভূমির প্রতি ফিলিস্তিনি জনগণের ভালবাসা কতটা গভীর তা ইবরাহিমের উদাহরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়। ইবরাহিম ২০০৮ সালে ইসরাইলি বাহিনীর সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের সময় দুই পা হারিয়েছিলেন। তখন প্রতিদিনই তাকে ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত অবস্থায় দেখা যেত। গত শুক্রবার বিক্ষোভের সময় অন্য প্রতিবাদকারী ফিলিস্তিনিদের উপস্থিতিতে তার বক্তব্য শোনা যায় এক ভিডিওচিত্রে। সেখানে তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি ইসরাইলি বাহিনীকে একটি কথাই বলতে এসেছি, এটি আমাদের ভূখ-। ট্রাম্পের ঘোষণায় আমরা এর অধিকার কিছুতেই ত্যাগ করবো না। আমরা আমাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যাবো।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, অন্যদের সুবিধার জন্য মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র বদলের ষড়যন্ত্র চলছে। ১৬ ডিসেম্বর ইস্তাম্বুলে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। এরদোগান আরো বলেন, একশ’ বছর আগের মতো আবারো চ্যালেঞ্জের মুখে মুসলিম বিশ্ব। রক্তপাত, চোখের পানি আর ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদের মাধ্যমে আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। তিনি আরো বলেন, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিচালিত হামলা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে যখন মতভেদ থাকে, তখন এর সুযোগ নেয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো এবং ইসরাইলের মতো দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কাজে লাগায়। এরদোগান- এর বক্তব্য মুসলিম বিশ্ব কতটা উপলব্ধি করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

http://www.dailysangram.com/post/311899