২০ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১১:১৮

ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া

বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা। ছুরিকাঘাত, অজ্ঞান ও গুলি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে তারা হরহামেশা। ছিনতাইকারীদের হামলায় আহত হচ্ছেন, পঙ্গু হচ্ছেন এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। অস্ত্রের পাশাপাশি নানা কৌশলও ব্যবহার করছে ছিনতাইকারীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তল্লাশির নামে লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব। প্রতিদিনই এরকম ঘটনা ঘটলেও ভুক্তভোগীরা থানা-পুলিশমুখো হচ্ছেন খুবই কম।
যে কারণে পুলিশের কাছে এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেশি নেই। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের হিসেবে সারা দেশে প্রতি মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ৮৩টি।
চলতি ডিসেম্বর মাসেই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে ঢাকায় প্রাণ হারাতে হয়েছে এক শিশু ও একজন চিকিৎসককে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার ভোরে। শরিয়তপুর থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন। উদ্দেশ্য অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসা করানো। সদরঘাট থেকে শনির আখড়া বোনের বাসায় রিকশাযোগে যাওয়ার পথেই সুস্থ শিশু সন্তানকে হারিয়েছেন এই দম্পতি। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নুরুল আমিন জানান, দয়াগঞ্জ রেললাইনের পূর্ব পাশে এক ছিনতাইকারী টান দিয়ে রিকশাআরোহী আকলিমার ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এসময় তার কোল থেকে পড়ে নিহত হয় ছয় মাসের শিশু আরাফাত।
তার আগে গত ৫ই ডিসেম্বর মারা গেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ফরহাদ আলম (৪০)। ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। ২৯শে নভেম্বর বিকালে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে রিকশাযোগে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন ফরহাদ। এসময় রিকশা থেকে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান এই চিকিৎসক। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর বলেন, মোটরসাইকেলে দুই ছিনতাইকারী চিকিৎসকের সঙ্গে থাকা টাকা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে। এসময় তিনি বাধা দিতে গেলে রিকশা থেকে পড়ে আহত হন। পরে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে বলে জানান ওসি।
গত ৮ই অক্টোবর ছিনতাইকারীদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু তালহা খন্দকারকে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটে ওয়ারীর টিকাটুলির কেএম দাস লেনে। ওই দিন সকালে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় তার সামনেই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছিলো। রিকশা আরোহী দুজনকে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছিলো ছিনতাইকারীরা। এসময় এক ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিয়ে ধরতে গেলে পেছন থেকে অন্য ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করলে নিহত হন তালহা।
১১ই ডিসেম্বর রাতে ওয়ারী এলাকায় এক নারীকে গুলি করে সর্বস্ব লুটে নেয় ছিনতাইকারীরা। গুলিবিদ্ধ শাহিদা আক্তারকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শাহিদার স্বামী শরিফ উদ্দিন জানান, রাত ১০টার দিকে রাজধানী সুপারি মার্কেট থেকে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন শাহিদা। সালাউদ্দিন হাসপাতালের পেছনে পৌঁছালে একটি মোটরসাইকেলে করে দুই ছিনতাইকারী তার পথরোধ করে। এ সময় ছিনতাইকারীরা তার ডান পায়ে গুলি করে গলার চেন এবং ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়।
শুধু গুলি, ছুরিকাঘাত করে না, ভিন্ন কৌশলেও ঘটছে ছিনতাই। ব্যবহার করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়। গত ৬ই ডিসেম্বর উত্তরায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে গার্মেন্ট কর্মকর্তাসহ দুজনকে মারধর করে ৪০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরে কুড়িল বিশ্বরোডে ওই দু’জনকে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। বেলা ২টার দিকে উত্তরার এক নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কে ঘটনাটি ঘটে। টোকিও মুড নামে ওই গার্মেন্টের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা রাসেল হাওলাদার জানান, টোকিও মুডের প্রধান কার্যালয় উত্তরার এক নম্বর সেক্টরের পাঁচ নম্বর সড়কে। কর্মচারীদের বেতনের টাকা উত্তোলনের জন্য উত্তরার প্রধান কার্যালয় থেকে মাইক্রোবাসে করে পাশের ১৩ নম্বর সড়কে ঢাকা ব্যাংকের শাখায় যান টোকিও মুডের হিসাবরক্ষক সাঈদ মাহমুদ আল ফিরোজ। সেখান থেকে ৪০ লাখ টাকা তুলে তিনি ও চালক রবি একই মাইক্রোবাসে করে কার্যালয়ে ফিরছিলেন। বেলা ১২ নম্বর সড়কে উত্তরা ক্লাবের সামনে যানজটে আটকা পড়েন তারা। ঠিক তখনই ঘটনাটি ঘটে। এ সময় চার ব্যক্তি গাড়ির সামনে গিয়ে নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে গাড়িতে অবৈধ মালামাল আছে জানিয়ে তল্লাশির কথা বলে। তাদের সঙ্গে ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ ও কোমরে রিভলবার ছিল। গাড়ির দরজা না খুললে গাড়িতে থাকা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাঈদ মাহমুদকে ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলে দুর্বৃত্তদের একজন। ওই সময়ে মাইক্রোবাসের কাঁচের ফাঁক দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চার জন। পরে আরো একজনসহ পাঁচজন। গাড়িতে ঢুকেই সাঈদ ও চালক রবিকে হাতকড়া পরায়। তাদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা, মোবাইলফোন, মাইক্রোবাসের কাগজপত্র কেড়ে নেয়। চোখ বেঁধে রাখে। এসময় তাদের মারধর করা হয়। দুর্বৃত্তরা মাইক্রোবাসটি কুড়িল বিশ্বরোডে নিয়ে যায়। কুড়িল বিশ্বরোডে নিয়ে সাঈদ ও রবিকে ফেলে দিয়ে আরেকটি গাড়িতে করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের স্পট রয়েছে শতাধিক। তবে ওয়ারী, দয়াগঞ্জ, শনির আখড়া, ধলপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, পুরান ঢাকার নবাববাড়ি, সদরঘাট, সূত্রাপুর, রায়েরবাজার, শেরেবাংলানগর, মানিক মিয়া এভিনিউ, লালমাটিয়া, দক্ষিণ বনশ্রী, শাহ আলী মাজার, মহাখালী, গাবতলী, গুলশান-বাড্ডা লিংকরোড এলাকায় প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডাকাতি, দস্যুতা বা ছিনতাইয়ের অভিযোগে সারা দেশে মামলা হয়েছে ৭৪৩টি। জানুয়ারিতে ৮৪, ফেব্রুয়ারিতে ৯২, মার্চে ৭৫, এপ্রিলে ৭৪, মে মাসে ৮১, জুনে ৮০, জুলাইয়ে ৮০, আগস্টে ৯৪ ও সেপ্টেম্বরে ৮৩টি। একই বিষয়ে গত ১০ মাসে ডিএমপিতে মামলা হয়েছে মাত্র ৯৮টি। জানুয়ারিতে নয়, ফেব্রুয়ারিতে ১৩, মার্চে আট, এপ্রিলে নয়, মে মাসে ১৫, জুনে সাত, জুলাইয়ে পাঁচ, আগস্টে ১৭, সেপ্টেম্বরে ছয় ও অক্টোবরে নয়টি।
ছিনতাইয়ের ঘটনার তুলনায় মামলা কম হওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলি ফেরদৌস বলেন, মামলা করার পরে আসামি শনাক্তসহ বিভিন্ন প্রয়োজেন একাধিকবার বাদীর কাছে পুলিশকে যেতে হয়। বাদীকে আসতে হয়। আদালতেও যেতে হয়। এই বিষয়কে অনেকে ঝামেলা মনে করেন। যে কারণে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পরও অনেকে মামলা করেন না। তবে মামলা হলে বা অভিযোগ পেলে পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বলে জানান তিনি। এছাড়াও ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের পেট্রোল টিম ও গোয়েন্দারা সক্রিয় রয়েছেন।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=96944