২০ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১১:১৪

বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা

ভাঙাচোরা মহাসড়কে মহাদুর্ভোগ : বাস ও ট্রেনের সিডিউল লন্ডভন্ড : ট্রেনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই : লঞ্চ চলাচল বিঘিত : ফেরি পারাপার থাকছে বন্ধ : গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলপ্লাজা বন্ধ : শাহজালালে ২০টি বিমান অবতরণ করতে পারেনি
ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়কের সাথে ঘন কুয়াশা। নির্ধারিত গতিতে চলতে পারছে না যাত্রীবাহী বাসসহ অন্যান্য যানবাহন। যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঘন কুয়াশায় নদীপথে লঞ্চ চলাচলেও বিঘ ঘটছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি পারাপার। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ট্রেনও বসে পড়ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে ট্রেনের সিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে আছে। উত্তরাঞ্চলের কোনো ট্রেনেই তিল ধারণের ঠাঁই মিলছে না। হজরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিভিন্ন গন্তব্য থেকে আসা ২০টি বিমান নির্ধারিত সময়ে অবতরণ করতে পারেনি। সবমিলে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। শীত বাড়ার সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার এ বেহাল দশায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ।

সারাদেশে মহাসড়কের বেহাল দশা। বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক এখনও মেরামত করা হয়নি। কুয়াশা এবং ভাঙাচোরা ও খানাখন্দের মহাসড়ক দিয়ে নির্ধারিত গতিতে চলতে পারছে না যানবাহন। মহাসড়কে লেগেই আছে যানজট। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ফরিদপুর, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। আর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে উত্তরাঞ্চলে যাত্রার প্রসঙ্গ উঠলেই আঁতকে উঠছে মানুষ। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক পাড়ি দিতে গিয়ে ভোগান্তি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সড়কপথে ঢাকা থেকে রংপুর যেতে এখন সময় লাগছে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা।
ভুক্তভোগি যাত্রীরা জানান, সড়কপথে ঢাকা থেকে রওনা করে বাইপাইল, চন্দ্রা, মির্জাপুর, এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতুর দুপাশে যানজটে পড়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঘন কুয়াশা এই ভোগান্তি আরো বাড়িয়েছে। যানজটের আরেক কারণ কুয়াশায় দুর্ঘটনা এড়াতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে গভীর রাত থেকে টোল প্লাজা বন্ধ রাখা। ভুক্তভোগীরা বিকল্প পথে যাত্রার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারছে না। ট্রেনের টিকিট মিলছে না। যদিও বা পাওয়া যায়, ঘন কুয়াশা ও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ট্রেনের সিডিউলও লন্ডভন্ড হয়ে আছে। রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, মহাসড়কের বেহাল দশায় ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে যাত্রীরা ট্রেনের দিকে ঝুঁকছে। সেটা এতো বেশি যে ঈদের চেয়েও যাত্রীর চাপ বেড়েছে। একদিকে, কুয়াশায় নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চলতে পারছে না। তার উপর অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলতে গিয়ে ট্রেনের বগী বসে পড়ছে। গত এক সপ্তাহে এরকম দুটো ঘটনায় ট্রেনের সিডিউল রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে, ঢাকা-সৈয়দপুর ও ঢাকা-রাজশাহী আকাশপথে টিকিট পাওয়াটাও যেন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। টিকিটের দাম বেড়ে হয়েছে তিন গুণ।

ঢাকা থেকে বগুড়াগামী এক বাস চালক জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিশেষ করে গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেনের কাজ চলায় দুই ঘণ্টার রাস্তায় সময় লাগছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। এই ১০ ঘণ্টায় হাজার হাজার যাত্রীকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বাকী মহাসড়কেও ভাঙাচোরা ও ঘন কুয়াশা বিপত্তির সৃষ্টি করছে। ৬ ঘণ্টার স্থলে ১৮/২০ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। এতে করে দুরপাল্লার বাসের সিডিউলও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাস টার্মিনালে যাত্রীরা ঈদের মতোই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে হাজার হাজার যাত্রীর অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। আলাপকালে রংপুরগামী আগমনী বাসের এক চালক বলেন, ঢাকা থেকে রওনা করে রংপুর পৌঁছতেই কেটে যাচ্ছে প্রায় একদিন। এমতবস্থায় পরের ট্রিপের আগে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগটাও পাচ্ছি না আমরা। এই অবস্থা কয়েক মাস ধরেই চলছে। রাজধানীর কলেজগেটে এসআর ট্রাভেলস পরিবহনের কাউন্টারের এক কর্মকর্তা বলেন, রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ হওয়ায় প্রতিনিয়ত গাড়ির শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। আগে চার-পাঁচটি গাড়ি রিজার্ভে রাখা হতো। এখন রংপুর রুটের প্রতিটি ট্রিপের জন্য বিকল্প গাড়ি রাখতে হচ্ছে। আগে প্রতি ঘণ্টায় ট্রিপ থাকলেও তা কমিয়ে আনা হয়েছে। তারপরেও যাত্রীদের ভোগান্তি লাঘব করা যাচ্ছে না। মহাখালী টার্মিনালের বাস মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, মহাসড়কের বেহাল দশার সাথে ঘন কুয়াশা মিলে সড়কপথের যাত্রা এখন অনেকটাই কঠিন হয়ে গেছে। যাত্রীরা কষ্ট পাচ্ছে, আমরা লোকসান গুনছি। ওই নেতা বলেন, গেলো বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক সময়মতো মেরামত না করার কারনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘন কুয়াশার কারণে গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায় বন্ধ রাখা হচ্ছে। সেতুতে দুর্ঘটনা রোধে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে করে সেতুর দুই পাশে দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ যানজট। আটকা পড়ছে দূরপাল্লার নৈশকোচসহ মালবাহী ট্রাক। এতে যে জট তৈরি হয় তা স্বাভাবিক হতে সেতু খুলে দেওয়ার পর দুই ঘণ্টার বেশি লেগে যাচ্ছে।

অপরদিকে, ঘন কুয়াশায় কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে। গত সোমবার রাতে ঘন কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা কমে আসায় ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে করে পদ্মা নদীতে যানবাহনসহ সাতটি ফেরি আটকা পড়ে। ওই দিন দৌলতদিয়া ঘাটে ছোট-বড় প্রায় চার শতাধিক যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় আটকে থাকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা পারাপারের গুরুত্বপূর্ণ পথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি। শীত মৌসুমে এসব নৌপথে ঘন কুয়াশার কারণে প্রায়ই পারাপার বিঘিœত হয়। প্রায় চার ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল আবার ফেরি চলাচল শুরু হয়।
কুয়াশায় ২০টি ফ্লাইটের অবতরণে দেরি
কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে। হজরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিভিন্ন গন্তব্য থেকে আসা ২০টি বিমান নির্ধারিত সময়ে অবতরণ করতে পারেনি। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার তারিক আহমেদ আল সাদিক জানান, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে স্পাইস জেটের একটি উড়োজাহাজের অবতরণের সময় ছিল। কিন্তু কুয়াশার কারণে এটি তখন অবতরণ করতে পারেনি। এরপর থেকে আরও ১৯টি ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে অবতরণ করতে পারেনি। সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি বিমান প্রথম অবতরণ করে।
সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় যাত্রীদের যেমন সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তেমনি বাস, লঞ্চ, ট্রাক মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ থেকে পরিত্রানের উপায় কী? জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের একটা সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দরকার। সড়কপথে সমস্যা হলে রেলপথ বা নৌপথ যাতে সাপোর্ট দিতে পারে সেজন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার কেউ নেই। তিনি এজন্য লন্ডনের আদলে ‘নিরাপদ যাতায়াত কর্তৃপক্ষ’ গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, এখন সময় এসেছে এ ধরনের কোনো সংস্থা গঠন করার। যারা যাত্রীদের ভোগান্তি ও দুর্দশা নিয়ে ভাববে, সমাধানের পরিকল্পনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/109171