১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৮

প্রশিক্ষণ ছাড়াই ভুল তথ্যে পাঠানো হচ্ছে বিদেশে

জীবিকার জন্য দেশের যে তরুণরা মরিয়া হয়ে বিদেশে যাচ্ছেন দালালদের হাতে নির্দিষ্ট ব্যয়ের তিন-চার গুণ টাকা তুলে দিয়ে, তাদের অধিকাংশের কাজের প্রশিক্ষণ নেই। নারায়ণগঞ্জের যে মো. আবদুল্লাহ অজানা কারণে ২ লাখ টাকা বাড়তি দিয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন কারখানা শ্রমিকের চাকরি নিয়ে, তিনি কাগজে-কলমে প্রশিক্ষিত হলেও আদতে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। দেশ ছাড়ার আগে তিন দিনের 'প্রশিক্ষণে' পাওয়া জ্ঞান সম্বল করে বিদেশে পাড়ি জমাবেন, কিন্তু সেখানে কোন ধরনের কারখানায় কী কাজ করতে হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। গত ১৩ ডিসেম্বর প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখায় দেখা হলে এ কথাই বলেছিলেন তিনি।
আবদুল্লাহর মতো লাখো প্রশিক্ষণহীন কর্মী যাচ্ছেন বিদেশে। সে কারণে বেতন পাচ্ছেন কম। প্রায়ই চাকরি হারাচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ, নোংরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদেশগামী কর্মী ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোরও এ সত্য অজানা নয়। কর্মীরা যেতে চান এবং লাভের আশায় রিক্রুটিং এজেন্সি অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যেনতেনভাবে বিদেশে পাঠাচ্ছে তাদের।

সরকারি হিসাবে ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪১ বছরে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে ১ কোটি ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৪১৮ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে শতকরা ৪৮ দশমিক ৯৫ ভাগই অদক্ষ। আধাদক্ষ ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ কর্মী। মাত্র ২ দশমিক ১৮ শতাংশ পেশাদার এবং বাকি ৩২ ভাগ 'দক্ষ' কর্মী। তবে পেশাদার ভিসায় যারা বিদেশে গিয়েছেন তাদের অনেকের দক্ষতা শুধু কাগজে-কলমে। প্রতারিত অভিবাসীদের সহায়তায় কাজ করা অনির্বাণ ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক আল আমিন নয়ন জানান, এমন নজির রয়েছে যে, পেশাদার ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে অক্ষরজ্ঞানহীন লোকজনকে। প্রকৃত পেশাদার না হওয়ায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে অবৈধ অভিবাসীতে পরিণত হয়েছেন তারা। ধারদেনা করে বিদেশে যাওয়ায় দেশেও ফিরতে পারছেন না। পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে এবং রাবার বাগান ও পাম বাগানে ঝুঁকিপূর্ণ নোংরা কাজ করছেন।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের তারানগরের কৃষক মোহাম্মদ খোরশেদকে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল, উচ্চ বেতনে মালয়েশিয়ার কৃষি খামারে কাজ দেওয়া হবে। যাওয়ার পর জানতে পারেন তাকে প্রফেশনাল ভিসায় পাঠানো হয়েছে। যে ভিসায় চিকিৎসক, নার্স, উদ্যোক্তা, শিক্ষক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীরা মালয়েশিয়ায় যান। অষ্টম শ্রেণি পাস খোরশেদকে 'পেশাদার' সাজিয়ে পাঠানো হয়। কুয়ালালামপুরে নেমেই মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার জেরার মুখে পড়েন। বেশভূষা ও ভাষার কারণে ধরা পড়েন। পরে দালালের মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে বের হতে পারলেও কাঙ্ক্ষিত কাজ পাননি। নির্মাণ শ্রমিকের কাজ দেওয়া হয়। অবৈধ নিয়োগ বলে দিনভর খাটুনির পরও মাসে ৬০০ রিঙ্গিত আয় করতে পারেন না। কাজ ফেলে দেশে ফিরেছেন কিন্তু মালয়েশিয়া যাওয়ার তিন লাখ টাকাই তার লোকসান।
গত বুধবার প্রবাসীকল্যাণ ভবনে নারায়ণগঞ্জের মো. আমিন ও আবু ছিদ্দিকের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, কেউ পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পার হতে পারেননি। কোন এজেন্সির মাধ্যমে, কী প্রক্রিয়ায়, কী কাজ করতে সৌদি আরবে যাচ্ছেন তাও বলতে পারলেন না। কেউ তাদের বলেনি বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
সৌদি আরবে কম্পিউটার প্রকৌশলে ডিপ্লোমা করা রায়হান আজিজ আবার যাওয়া প্রসঙ্গে আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ঢাকার বাংলাদেশ-কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে। প্রথম দিনে শুধু নাম ডাকা হয়েছিল। দ্বিতীয় দিনে একজন প্রশিক্ষক হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে বলেন, বিদেশে গিয়ে কী করা যাবে, কী করা যাবে না। কিছুই বুঝতে পারেননি। তৃতীয় দিনে তাকে একটি সনদ দিয়ে দেওয়া হয়।
অন্য কর্মীদের একই রকম অভিজ্ঞতা প্রশিক্ষণ সম্পর্কে। সৌদি আরব থেকে টেলিফোনে নোয়াখালীর নাসির উদ্দিন জানান, তিনিও একই ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছেন। আত্মীয়-স্বজনকে ধরে দোকানে কাজ পেয়েছেন। প্রবাসে যাদের আত্মীয়-স্বজন নেই, সহায়তা করার কেউ নেই, তারা পথে পথে ঘুরছেন। কাজ পাচ্ছেন না।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. সি আর আবরার সমকালকে বলেন, কর্মীদের দক্ষ করে তোলার বিষয়টি কখনও গুরুত্ব পায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশে কর্মসংস্থানের তীব্র অভাব, তাই সরকারের নীতি হলো যেভাবেই হোক কিছু লোককে বিদেশে পাঠিয়ে বেকারের সংখ্যা কমানো। যারা বিদেশে যেতে চান তারাও আয়-রোজগারের আশায় মরিয়া, যেভাবেই হোক বিদেশে যেতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অবস্থান হলো, টাকা উপার্জনে যেভাবে হোক কর্মী পাঠাতে হবে; দক্ষ হোক আর না-ই হোক। তিনি বলেন, দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠাতে পারলে তা অনেক বেশি লাভজনক।
দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশি কর্মীরা আয়ের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, নেপাল, ভারত এমনকি পাকিস্তানিদের চেয়েও। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে কাজ করলেও বছরে রেমিট্যান্স আয় ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। ফিলিপাইনের ২৮ লাখ প্রবাসী কর্মী বছরে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান ৩০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশিদের আয় ফিলিপিনের চার ভাগের এক ভাগেরও কম।

সি আর আবরার সমকালকে বলেন, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে বিদেশে পাঠায়। ইংরেজি ভাষার দক্ষতায় তারা অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশি কর্মীরা যে দেশে যান, সে দেশের ভাষারও প্রাথমিক জ্ঞান ছাড়াই যান। এর জন্য সরকারকে দায়ী করেন তিনি।
তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, দক্ষ কর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বছর বছর বিদেশগামী কর্মীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের দক্ষতা বাড়েনি। গত বছর বিদেশগামী ৭ লাখ ৫৭ হাজার কর্মীর ৩ লাখ ১৮ হাজার ছিলেন দক্ষ, যা শতকরা হিসাবে ৪২ ভাগ। বাকি ৫৮ ভাগ অদক্ষ ও আধাদক্ষ।

ভারতীয় ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশটি থেকে যাওয়া কর্মীর ৫৬ ভাগ ছিলেন দক্ষ। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৩ ভাগ। পাকিস্তান ও নেপাল দক্ষ কর্মী রফতানি করেছে ৫৩ ও ৪৮ ভাগ।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত 'সাফল্যে পাঁচ বছর'-এ দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটির পাঁচটি মেরিন টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসহ ৭১টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটউট রয়েছে। তাতে ৪৭টি ট্রেডে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এবং উপজেলা পর্যায়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা সমকালকে বলেন, তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোর অভাব, জনবল সংকট, কর্মীদের অনীহার কারণে শতভাগ কর্মীকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

http://samakal.com/bangladesh/article/17121090