৯ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৭:৫৬

চিকিৎসকদের গ্রাম ছাড়ার হিড়িক

গ্রামের কর্মস্থলে নেই ৩৩তম বিসিএসের ৭৫% চিকিৎসকই

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে স্ত্রীকে ভর্তি করিয়েছেন মোকসেদুর রহমান। অনেক দিন ধরেই স্ত্রীর নাক দিয়ে মাঝেমধ্যে রক্ত আসে।
আগে কোনো ডাক্তার দেখানো হয়নি। ঢাকায় থাকা এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি সরাসরি ঢাকায় নিয়ে আসেন স্ত্রীকে। স্থানীয় কোনো ডাক্তার দেখাননি কেন জানতে চাইলে মোকসেদুর বলেন, ‘দুই দিন উপজেলা হাসপাতালে নিয়া গেছিলাম। কিন্তু এই সমস্যা যেই ডাক্তার দেখতে পারে সে নাকি কয়েক দিন আগেই ঢাকায় বদলি হয়ে আসছে। নিরুপায় হয়ে ঢাকায় নিয়া আসছি। এখানে অনেক খরচ। নিজ এলাকায় যদি ডাক্তার থাকত তাইলে অনেক সহজ হইত। ’
উল্লিখিত বিষয়ের চিকিৎসক না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইনচার্জ ডা. সাজ্জাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার এখানে তো মাথাই খালি পড়ে আছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা, দুজন আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারসহ মোট আটটি পদ শূন্য আছে।
এখন আছি পাঁচজন, তাও কিছুটা জোড়াতালি দিয়ে। বাকিরা কেউ বদলি হয়ে গেছে, কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ৩৩তম বিসিএসের। আমি নিজেও ৩৩তম বিসিএসের, তাও আমাকেই ইনচার্জের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ’
পটুয়াখালীর দুর্গম উপজেলা রাঙ্গাবালীতে সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হয়নি এখনো। ফলে ওই উপজেলার মানুষের ভরসা এখনো পার্শ্ববর্তী গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেদিকে খেয়াল রেখেই সরকারের পক্ষ থেকে মোট চিকিৎসকের পদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৩৯টি। কিন্তু বাস্তবে আছেন মাত্র ১৪ জন চিকিৎসক, ২৫টি পদই শূন্য। গাইনির ডাক্তার নেই একজনও। অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তারও নেই। ফলে পরিত্যক্ত হয়ে আছে আধুনিক যন্ত্রপাতিসংবলিত নতুন অপারেশন থিয়েটার।

কেন এ অবস্থা জানতে চাইলে গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, বড় সমস্যা একটাই—সব থাকলেও ডাক্তার থাকেন না। অনেকেই পোস্টিং নিয়ে এসে কিছুদিন থেকে চলে যান। ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৯ জনকে এখানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১০ জনই বিভিন্ন অজুহাতে এখান থেকে চলে গেছেন।
শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ছয়টি ইউনিয়ন মিলে মোট ২৫ জন চিকিৎসকের পদ বরাদ্দ আছে। কিন্তু চিকিৎসক আছেন মাত্র পাঁচজন। ২০টি পদই ফাঁকা।
এভাবে বড় শহর থেকে দূরের প্রায় অর্ধশত উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের প্রায় ৭৫ শতাংশই কোনো না কোনো অজুহাতে সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে চলে গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক শাখার একাধিক কর্মকর্তাও জানান, ২০১৪ সালে সরকার একযোগে যে ছয় হাজার ডাক্তার নিয়োগ করে গ্রামে পোস্টিং দিয়েছিল তাঁদের প্রায় ৭৫ শতাংশই এরই মধ্যে গ্রামছাড়া হয়েছেন। বাকিরাও প্রস্তুতি নিয়েছেন গ্রাম ছাড়ার। ফলে আবারও সরকারি চিকিৎসকশূন্য হয়ে পড়ছে একেকটি এলাকা। চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষ।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মাহসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার তো মনে হয় ৮০ শতাংশেরও বেশি চিকিৎসক মফস্বলের কর্মস্থল ছেড়ে চলে এসেছেন। আমি নিজেও মনে করি, ডাক্তারদের এভাবে গ্রাম ছেড়ে আসার সুযোগ দেওয়াটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। সবাই যদি এভাবে উচ্চতর শিক্ষার অজুহাতে একযোগে গ্রাম ছেড়ে আসে তবে গ্রামের স্বাস্থ্যসেবা দেবে কারা? এ ক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনার ঘাটতি আছে। আগামীতে এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে সবাইকেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। ’ তিনি জানান, শিগগিরই আরো ১০ হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম ধাপে পাঁচ হাজার নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু সামা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাদের এখানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল তাদের কেউ গেছেন উচ্চশিক্ষার অজুহাতে, কেউ ডেপুটেশনে, আবার কেউ বদলি হয়ে চলে গেছেন। আমি আর কী করতে পারি! যারা আছে তাদের নিয়েই কোনোমতে যতটুকু সম্ভব সেবা দিয়ে যাচ্ছি। চলে যাওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগই ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। ’ তিনি জানান, ছয়টি ইউনিয়নের সব কটিরই চিকিৎসক পদ এখন ফাঁকা।

খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোমান বলেন, এখন ৯ জন ডাক্তার আছেন, কিন্তু তিনজন উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সাকুর বলেন, ‘আমার সাত উপজেলার কোনোটিতেই তিন-চারজনের বেশি ডাক্তার নেই। প্রতিটিতেই গড়ে ৭০-৭৫ শতাংশ পদ শূন্য হয়ে গেছে। ’
ভোলার মনপুরায় ১৩টি পদের মধ্যে এখন আছেন মাত্র চারজন। ৩৩তম ব্যাচের যাঁদের সেখানে পদায়ন করা হয়েছিল তাঁদের দুজন বাদে সবাই চলে গেছেন বলে জানান সহকর্মী ডা. জাকির হোসেন।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় চিকিৎসকের পদ ৩৪টি, কিন্তু এখন আছেন সাতজন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল গফুর বলেন, ‘যাঁরা চলে গেছেন তাঁদের বেশির ভাগই ৩৩ ব্যাচের। ওঁদের আমরা ধরে রাখতে পারিনি। ’
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, নোয়াখালীর হাইমচর, জামালপুরের বকশীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের চৌহালী ও কাজীপুর উপজেলায়ও একই চিত্র পাওয়া গেছে।

প্রবীণ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্রামে ডাক্তার রাখতে না পারার ব্যর্থতার দায় সরকার এড়াতে পারে না। সরকারের পরিকল্পনায়ই গলদ আছে। সব কিছুতেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ওই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘শিক্ষা অবস্থায়ই মেডিক্যালের ছাত্রদের গ্রামে পাঠানো উচিত। ডাক্তারদেরও মানসিকতার সমস্যা আছে। তারা কমিউনিটি মেডিসিন পড়লেও কেনো কমিউনিটিতে যাবে না। কমিউনিটিতে না গেলে তারা শিখবেটা কী? অভিজ্ঞতা পাবে কোথায়? গ্রামের মানুষই বা সেবা পাবে কিভাবে?’
বিএমএর মাহসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ডাক্তার ভাই-বোনদের উদ্দেশে বলব, আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই সবাইকে গ্রামে থাকার মানসিকতা গড়তে হবে। নয়তো আমাদের সম্পর্কে মানুষের ভুল বোঝার সুযোগ তৈরি হবে। যারা এলাকায় আছে তাদেরও আরেকটু দায়িত্বশীল আচরণ করলে ভালো হবে। ’
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গণি মোল্লাহর বৃদ্ধা মা। দুপুর ২টায় তিনি খবর পান। রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো তেমন কেউ ওই সময় বাড়িতে না থাকায় ডাক্তার গণি নিরুপায় হয়ে ঢাকা থেকে ফোন করেন স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম মারুফ হাসানের কাছে। তিনি অনুরোধ করেন উপজেলা হাসপাতালের কোনো একজন চিকিৎসককে তাঁর বাড়িতে পাঠানোর জন্য। কিন্তু ওই সময় সাতক্ষীরায় নিজ বাসায় অবস্থানরত ডা. মারুফ হাসান জানিয়ে দেন, হাসপাতালে ডাক্তার সংকট থাকায় কাউকে ডা. গণির বাড়িতে পাঠানো সম্ভব নয়। ওই অবস্থায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর পুরুষ সদস্যরা বাড়িতে পৌঁছে অন্য মাধ্যমে রোগীকে খুলনার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান।

অধ্যাপক ডা. গণি মোল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি একজন ডাক্তার হয়ে নিজেই দুঃখ ও লজ্জা পেয়েছি। গ্রামের সাধারণ মানুষ এমন পরিস্থিতিতে কী ভোগান্তিতে পড়ে তা সহজেই বোঝা যায়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিজেই মাসের বেশির ভাগ সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। তাঁর নিচের পদের ডাক্তাররা থাকবেন কী করে?’
ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মারুফ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার এখানে ২৪টি পদের মধ্যে ডাক্তার আছেন মাত্র সাতজন। ১৪টি ইউনিয়নের কোথাও ডাক্তার নেই। বিভিন্ন অজুহাতে চলে গেছেন। ফলে হাসপাতাল চালানো মুশকিল। অপারেশন থিয়েটার পরিত্যক্ত। কোনো ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার নেই। যাঁরা আছেন তাঁদেরই সারাক্ষণ ঘুরেফিরে কাজ করতে হচ্ছে। ’
চিকিৎসকরা কেন গ্রামে থাকতে চান না জানতে চাইলে ডা. মারুফ হাসান বলেন, থাকার মতো উপযুক্ত পরিবেশ নেই, প্রয়োজনীয় আবাসিক অবকাঠামো নেই, পরিবহন নেই, নিরাপত্তা নেই। আবার সরকারি বাসায় থাকলে যে টাকা কাটা হয় ওই টাকার চেয়ে অনেক কম ভাড়ায় বরং ওই উপজেলায় ভালো মানের বাসা পাওয়া যায়। এর সঙ্গে উচ্চশিক্ষার তাগিদ এবং শহরে পরিবারের সঙ্গে থাকার আগ্রহটাই বেশি কাজ করে।

গলাচিপায় যে ১৪ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন তাঁদের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন ‘আমরা এখন এখানে যারা আছি সবাই স্থানীয়। এই এলাকায়ই বাড়ি। আমি এখানে আছি ১১ বছর। প্রথম পোস্টিং ছিল এখানে, এখন উপজেলা কর্মকর্তা হয়েও এখানেই আছি। ঢাকা বা অন্য কোথাও আমার মন মানে না। এখন যাঁরা আমার সঙ্গে আছেন তাঁরাও এমন কারণেই এখানে আছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য এলাকার কেউ এসে এখানে থাকতে চায় না। ’
দেশে গ্রামপর্যায়ে নতুন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের অবকাঠামো হচ্ছে, অবকাঠামো সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, ৩১ বেডের হাসপাতাল ৫০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু সংকট লেগে আছে চিকিৎসকের। প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বারবার কড়া নির্দেশনায়ও কাজ হচ্ছে না। গ্রামে থাকার শর্তে চাকরি নিয়েও পদায়ন হওয়ার পর পাল্টে যায় বেশির ভাগ চিকিৎসকের আচরণ। মাঝে কিছুদিন পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও এখন আবার রীতিমতো চিকিৎসকদের গ্রাম ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ফাঁকা হয়ে পড়েছে ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো।

পরিস্থিতি এতটাই নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ২৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘ডাক্তাররা বেশ প্রভাবশালী ও তদবিরে পাকা। প্রভাব খাটিয়ে তদবির করে বদলি হয়ে যায়। অনেকে তদবির করে উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণে চলে যায়। ’ ওই দিন সংসদে উপজেলাপর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকার ব্যাপারে সরকারের কাছে জবাবদিহি চাইছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য মো. ইয়াসিন আলী। প্রতিমন্ত্রী অবশ্য দেশে চিকিৎসকের স্বল্পতা থাকার বিষয়টিও জাতীয় সংসদকে অবহিত করেন।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/12/09/575299