৯ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৭:০৫

মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে ভুল না অন্যকিছু?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টে প্রকাশ, মাদরাসা বোর্ডের ভুলেভরা ২৪ লাখ পাঠ্যবই বাতিল করা হয়েছে। এজন্য গচ্চা যাচ্ছে ১০ কোটি টাকা। এভুলগুলো কী? কারা করেছেন এসব ভুল? এমন প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক।

পত্রিকাটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, হাদিসের অপব্যাখ্যাসহ আরও অসংখ্য ভুলের জন্য ওইসব বই প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ৭ম ও ৮ম শ্রেণির আকাঈদ ও ফিক্হ এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেণির কুরআন মজিদ ও তাজবিদ এবং হাদিস শরীফ এ বইগুলো বাতিলের নির্দেশ দিয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে এসব অভিযোগের কারণে বেশকিছু পাঠ্যবই সংশোধনের কথা ছিল। এব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিন বছরে তা সংশোধন করা হয়নি। ফলে ভুলেভরা বইগুলো ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের জন্য আবারও ছাপা হয়েছে। এখন এই বই প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নতুন করে ছাপাতে বলা হয়েছে।
নতুন করে বই ছাপবার ব্যাপারে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র সাহা বলেন, এনসিটিবি শুধু বই ছাপবার কাজ করে। মাদরাসার কারিকুলাম সম্পূর্ণই মাদরাসা বোর্ড তৈরি করে দেয়। তারা পাণ্ডুলিপির সিডি পাঠায়, আমরা ছাপাই। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে ৪ টা বই পরিমার্জিত হবে। আমরা সে অনুসারে কাজ করছি। কোন কারণে পরিমার্জন করা হয়েছে আমরা জানি না।

পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, ৭ম শ্রেণির আললুগাতুল আরাবিয়াতুল ইত্তিশালিয়া বইয়ের ১২২ পৃষ্ঠার একটি কবিতায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের দেশের যুবক, আমরা প্রত্যাশার প্রতীক, সম্মানের তরে এবং জিহাদের জন্য....।’ ৮ম শ্রেণির একই বইয়ে জিহাদের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়া হয়েছে। ৭ম শ্রেণির হাদিস শরীফ বইয়ের ১৩৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্র দীন কায়েমের সকল প্রকার প্রচেষ্টা, আল্লাহ্র বিধান প্রচার ও প্রসার, দীনী শিক্ষা ও তৎপরতার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।’

এভাবে বিভিন্ন বইয়ে জঙ্গিবাদ ও কোমলমতি শিশুদের মনে বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষকরা। এগুলো ছাড়া আরও কিছু পাঠ্যবইয়ে সমস্যা ধরা পড়েছে। সববই ছাপতে গেলে জানুয়ারিতে তা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না। গচ্চা যাবে আরও ৩০ কোটি টাকা। অভিযোগ আনা হয়েছে যে, এসব পাঠ্যবই লেখকদের ৩৪ জনের মধ্যে অধিকাংশই জামায়াত-বিএনপি ঘরানার। প্রশ্ন হলো, এরা ছাড়া আর কারা দীন ইসলাম সম্পর্কে পাঠ্যবই লিখবেন? অন্যরাতো ইসলামকে ঘৃণা করেন এবং এড়িয়ে চলেন।
এটা আমাদের জেনে রাখা উচিত যে, জিহাদের অর্থ কিন্তু কোনও দেশ বা জাতিকে আক্রমণ করা নয়। এর অর্থ সন্ত্রাসও নয়। জিহাদের প্রকৃত অর্থ শান্তি ও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান। অপব্যাখ্যার ফলে জিহাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। শব্দটা শুনে অনেকে ভীত-সšস্ত হয়ে পড়েন। এছাড়া জিহাদ কেবল যুদ্ধ নয়, সংগ্রাম বা সংঘর্ষ নয়। লোভ, মোহ এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনকেও বোঝায়।
ইসলাম হচ্ছে কল্যাণময় জীবনাদর্শ। শুধু মানুষ নয়, কোনও প্রাণীরই অকল্যাণ চায় না এই জীবনদর্শন। ইসলাম বলেছে, কুল্লু মুসলিমিন ইখওয়ান। সমস্ত মুসলিম ভাইভাই। প্রকৃত ভাই যেমন অন্য ভাইয়ের অমঙ্গল চাইতে পারে না, ঠিক তেমনই এক মুসলিম আরেক মুসলিমের অকল্যাণ চাইতে পারে না। এমন ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যে সমাজে বিরাজমান সে সমাজ প্রকৃত মানুষের সমাজ।

ইসলামে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের কোনও স্থান নেই। তবে কেউ যদি আক্রান্ত হয় তাহলে হাত-পা গুটিয়ে থাকতেও বলা হয়নি। ইসলাম শুধু থিউরিভিত্তিক দীন নয়। বরং বাস্তবভিত্তিক। শুধু কথায় চিঁড়ে ভেজে না। প্রয়োজনে পানিও ঢালতে হয়। অনেকে মনে করে ইসলাম শুধু সুন্দর সুন্দর কথাই বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়, প্রয়োজনে ডাণ্ডা মেরে দুশমন দমনও করতে বলা হয়েছে। তবে আগে কাউকে আক্রমণের হুকুম দেয়া হয়নি।
ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে, আল্লাহর পথে লড়াই (জিহাদ) কর জান ও মাল দিয়ে। ইসলামের নির্দেশ মানে আল্লাহ্র হুকুম। তবে এর প্রেক্ষিত রয়েছে। এ জিহাদ বা লড়াই সবাই করতে পারবে না। সবাইকে তা আল্লাহ্ তায়ালা করতেও বলেননি। এজন্য অথরিটি থাকতে হবে। এর মানে প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষণা করা যেতে পারে। কারুর খেয়াল-খুশি মতো জিহাদ ঘোষণা করা যায় না। আর কোনও পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষণা হলে এর বিপরীতে দেশের নাগরিকদের দাঁড়াবারও সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রীয় হাইকমান্ডের। তবে সে কমান্ড পরিচালনার জন্য পরামর্শসভা থাকতে পারে।

কয়েক দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে শাহরিয়ার কবির এখানকার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ইসলামশিক্ষা বিষয়ক পাঠ্যবইয়ের কঠোর এবং অশালীন ভাষায় সমালোচনা করলেন। তিনি বললেন, এই দেখুন পাঠ্যবইয়ে অজু করতে শেখানো হচ্ছে, নামায পড়তে বলা হচ্ছে। ‘অ-তে অজু কর। ন-তে নামায পড়।’ এভাবে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ছড়াবার অভিযোগ করলেন তিনি। স্কুলটা মুসলিম শিশুদের জন্য, বইটাও তাদের নিজস্ব দীনী শিক্ষার জন্য। এতে অপরাধ কী? এ স্কুলে যদি অমুসলিম শিশু পড়ে তাহলে সেখানে তাদের নিজস্ব ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থাতো থাকেই। কবির সাহেবদের গাত্রদাহ কেন?

কবির সাহেবরা এদেশ ও সমাজ থেকে ইসলামের নাম ও নিশানা মুছে দিতে বদ্ধপরিকর। এজন্য তাদের ওপর অনেক চাপ রয়েছে। ইসলামের অস্তিত্ব কোথাও দেখলেই তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
ইসলামের মূল কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। অর্থাৎ: আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই মুহম্মদ (সা.) আল্লাহ্র রসূল। এ কালেমার গুরুত্ব এবং ব্যাপকতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হলে একমাত্র রব হিসেবে আল্লাহ্ তায়ালাকে মেনে নেয়া ব্যতীত উপায় নেই। অন্যদিকে পৃথিবীর সকল শক্তিকে উপাস্যরূপে অস্বীকার করে আল্লাহকে ইলাহ মেনে প্রেরিত রাসূলকে রাহবাররূপে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক। কালেমা তাইয়েবার মর্মার্থ যদি এটাই হয় তাহলে আমাদের অর্থাৎ যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করি তাদের কর্তব্য করণীয় কী তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়।

সালাত বা নামায কায়েম, দীন প্রতিষ্ঠা, কালেমার দাওয়াতকে যদি সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয় তাহলেতো কালেমা তাইয়্যেবা তথা ইসলামই জঙ্গিবাদ হয়ে গেল। এমন প্রচারণাই বিশ্বব্যাপী চালানো হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, ইসরাইল, চীন এবং আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশটিও। এরপর দেশজ বিশেষ মহলও এখন আল্লাহ্র দীনের দাওয়াতকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বলে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে।
যে দেশের ৯০% নাগরিক কালেমায় বিশ্বাসী, যে দেশের লাখ লাখ মসজিদে দিনে ৫ বার আযান হয়, সে দেশে যদি শিশুদের পাঠ্যবইয়ে আল্লাহ্র কথা না থাকে, সালাত-সিয়াম প্রশিক্ষণের নির্দেশনা না থাকে তাহলে তা কোথায় থাকবে?

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যবইয়ে মুসলিমদের জন্য কিছু রাখাতো হয়ইনি; মাদরাসার শিক্ষা কারিকুলাম থেকেও ঈমান-আকিদা বিষয়ক পাঠ্য বিষয়কে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস আখ্যা দিয়ে তা বন্ধ করে দেবার দাবি করছে নাস্তিক্যবাদের এদেশীয় চামচারা। তাদের এমন সাহসিকতার প্রশংসা না করে উপায় আছে?
অবস্থা দেখে মনে হয়, কুরআন-হাদিসের শিক্ষা, দীন ইসলাম সম্পর্কে পাঠপ্রণয়ন এবং তা থেকে পাঠ নিতে দিল্লি, কোলকাতা ও মস্কো থেকে ওস্তাদ আমদানি করতে হবে। এখানকার ইসলামী শিক্ষাবিদরাতো সবাই স্বাধীনতাবিরোধী অথবা জামায়াত-বিএনপি’র।

মাদরাসা বোর্ডের শুধু পাঠ্যবই নয়, খোদ মাদরাসাই বন্ধ করে দেবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিন-চারখানা বই বাতিল এবং তা নতুন করে ছেপে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা গচ্চা তো মামুলি ঘটনা। তবে এটাকে কৈয়ের তেলে কৈভাজাও বলতে পারেন। আমরা জানি, এ জাতির খেয়েপরে এ জাতিরই ঘাড় মটকে দেবার আয়োজন চলছে দীর্ঘদিন থেকে। আমরা কেবল নাকে তেল দিয়ে সুখনিদ্রায় মগ্ন আছি। কখন নিদ্রাভঙ্গ হবে- কে জানে!

http://www.dailysangram.com/post/310492