৬ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৮:৪২

রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রকল্প কেন ?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : এক চরম অনিশ্চিত ও লক্ষ্যহীনতার মধ্য দিয়ে চলছে সরকার। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বিশাল বোঝা নিয়ে কোন দিকে যে যাচ্ছে, তা বোধকরি সরকার নিজেও জানে না। নানা বিভ্রান্তির মধ্যে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী সরকারের সঙ্গে এক চুক্তি করেছে গত ২৩ নভেম্বর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঢাকায় ফিরে স্বীকার করেছেন যে, মিয়ানমারের ইচ্ছানুযায়ী তাদের মতো করেই একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ একে চুক্তি বললেও মিয়ানমার সরকার একে চুক্তি বলে স্বীকারই করেনি। তারা একে বলেছে, বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের ‘আয়োজন’ (অ্যারেঞ্জমেন্ট)। যা কোনো কূটনীতির ভাষা নয়।

সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা নাকি সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য। এমনই দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত উন্নাসিকভাবে বলেছেন, কি হয়েছে, কি হয়নি, এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই। কিন্তু তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ কেন এমন একটি আত্মসমর্পণমূলক চুক্তি করতে গেল, সেটাও বোঝা দায়; তাও আবার মিয়ানমারের শর্ত অনুযায়ী। দৃশ্যত এর উদ্দেশ্য মিয়ানমার থেকে পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়ে, গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে, চোখের সামনে বাড়িঘর জ্বলতে দেখে যারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফিরিয়ে নেয়া। কিন্তু তার জন্য মিয়ানমার যেসব শর্ত দিয়েছে, তাতে তাদের প্রত্যাবাসন প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আয়োজনের একেবারে শুরুতেই বলা হয়েছে, যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে চায়, শুধু তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিই বিবেচনা করা হবে। কিন্তু মিয়ানমার বাহিনী সেখানে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর নির্যাতনের যে বর্বরতা চালিয়েছে, তাতে উপযুক্ত নিরাপত্তা না পেলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা কিছুতেই সেখানে ফিরতে চাইবে না। তাছাড়া তারা ফিরবেই বা কোথায়? তাদের ঘরবাড়ি ফসলের জমি সব কিছু তো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। সেখানে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে মিয়ানমারের চরমপন্থী বৌদ্ধদের, যারা ওপরে উল্লিখিত সেনা বর্বরতার প্রত্যক্ষ সহযোগী।

এই ‘আয়োজনে’র সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষ যুক্ত নেই। যদি জাতিসংঘ বা জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনকে (ইউএনএইচসিআর) যুক্ত করা যেত, তাহলেও রোহিঙ্গা মুসলমানগণ স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী হতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সে রকম কোনো কিছু ওই ‘আয়োজনে’ সংযুক্ত করতে পারেনি। এতে বলা হয়েছে, আগামী দু’মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করবে। কিন্তু কবে তা শেষ হবে, তা আয়োজনে উল্লেখ নেই। অথচ ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সে সময় ছয় মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার চুক্তি হয়েছিল। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিল ইউএনএইচসিআর। ইউএনএইচসিআর যাদের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বলে শনাক্ত করেছিল, মিয়ানমার তাদের ফেরত নিয়েছিল। সে অনুযায়ী দুই লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তবু রয়ে গেছে আরো প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা। এখন তাদের সে জনসংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। মিয়ানমার সরকার আগের উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনাই করতে চায়নি।

কিন্তু এই আয়োজন অনুযায়ী যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ফেরা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। গোটা আয়োজনটাই ঝাপসা। সে কারণেই বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই আয়োজনকে ‘স্টান্টবাজি’ বলে অভিহিত করেছে। কারণ এখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুস্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত নেই। এদিকে সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ করেছে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এর ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলো এবং মিয়ামারকে এই প্রক্রিয়ায় আরো ঢিলেমি করার সুযোগ দেয়া হলো।

এই অর্থ বরাদ্দ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে যে আয়োজন করেছে, তার কার্যকারিতা বিষয়ে তারা নিজেরাই নিশ্চিত নয়। সরকারও সম্ভবত মনে করে যে, মিয়ানমার আসলে তাদের ফেরত নেবে না। এর ফলে মিয়ানমার এমন বার্তা পেল যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলেও চলবে। আর সে বার্তাও মিয়ানমার ইতিমধ্যে দিতে শুরু করেছে। এমনকি যেদিন আয়োজনটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিদিনই মিয়ানমার সরকার আরো রোহিঙ্গাকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে মিয়ানমারের শঠতা প্রমাণিত হয়। মিয়ানমারের রক্তপিপাসু নেত্রী অং সান সু চি যদিও বলেছেন যে, এই প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে। কিন্তু সেই কাম্য নিরাপত্তা বিধান কে করবে। সে রকম কোনো কর্তৃপক্ষ এই আয়োজনে উপস্থিত নেই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন, এই আয়োজনে বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দেয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থটা কোথায় সংরক্ষণ করা হয়েছে তা তিনি দেখাতে পারেননি। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে নাগাদ শেষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই আয়োজন বহাল থাকলে মাহমুদ আলীর জীবদ্দশায় যে প্রত্যাবাসন শেষ হবে না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত স্থানীয় বৌদ্ধরা’ যদি রোহিঙ্গাদের মেনে নেয়, কেবল তখনই তারা মিয়ানমারে ফিরতে পারবে। এও আজব কথা। ‘স্থানীয় প্রকৃত বৌদ্ধরা’ রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাতে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ রোহিঙ্গা গণহত্যায় তারাও সেনাবাহিনীর শরিক। মিয়ানমারের নেত্রী সু চি বলেছেন, মিয়ানমার কেবল তাদেরই ফেরত নেবে, যাদের কাছে মিয়ানমারে বসবাসের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। নাগরিকত্ব সনদ, পরিচয়পত্র ইত্যাদি। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাতে তারা প্রমাণ নিয়ে আসতে পারার কথা নয়, অনেকের প্রমাণ জ্বলে গেছে। এদিকে আবার ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্বও কেড়ে নেয়া হয়েছে। তারা কিভাবে তা প্রমাণ করবেন। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের যে নিবন্ধন করেছে, মিয়ানমার সে নিবন্ধনকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করবে না। তাহলে উপায়?

এদিকে কে প্রত্যাবাসন-প্রত্যাশী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে? আয়োজনে সুস্পষ্টই বলা হয়েছে যে, তাদের সরাসরি রাখাইনে আশ্রয় নাও দেয়া হতে পারে। প্রথমে তাদের কোনো সুবিধাজনক স্থানে ক্যাম্পে রাখা হবে। তারপর কোনো সুবিধাজনক স্থানে তাদের পুনর্বাসন করা হবে। তা যে রাখাইনেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। কারণ মিয়ানমার সরকার ইতিমধ্যেই তাদের বাড়িঘরের স্থান ও জায়গাজমি নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে।

তবে এই আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ মিয়ানমারের বড় উপকার করেছে। এই প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘসহ কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই। মিয়ানমার যদি মনে করে সহায়তা দরকার, তবে তারা ইউএনএইচসিআরের সহায়তা চাইবে। তবে তাদের জন্য দরকার মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে বলে যাচ্ছে যে, তৃতীয় কোনো পক্ষ ছাড়াই বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক অব্যাহত রেখে আমরা এই চুক্তি সম্পাদন করেছি। আমরা উভয় দেশই জিতেছি। কিন্তু স্বার্থ বিসর্জিত হয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে সরকার নিজেও নিশ্চিত নয়। আর সম্ভবত সে কারণেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

সমালোচকরা বলছেন, সরকার দ্রুত একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য মিয়ানমারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমার ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে এবং এখনো ঠেলে পাঠাচ্ছে। আর এ জন্য সরকার মিয়ানমারের কাছে কোনো ক্ষতিপূরণও দাবি করেনি। আর বাস্তবতা হলো এই যে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের শত্রুতা করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব সমস্যা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি করেছে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট। আমরা তাদের প্রায় ১০ লাখ লোকের বোঝা কাঁধে নিতে বাধ্য হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করিনি। আর মিয়ানমারও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ফলে এই আয়োজন বা চুক্তি একটি ধোঁকায় পরিণত হয়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধকারী মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের যাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি না হতে হয়, সে জন্য মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত একটি দ্বিপক্ষীয় আয়োজন চেয়েছিল। মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের বাংলাদেশ সে সুযোগ করে দিল। এদিকে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশন এক বৈঠকে বসে মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের তথ্য চেয়েছে। ফলে মিয়ানমার আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
এদিকে ইউএনএইচসিআর বলেছে, বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পুনর্বাসন অসম্ভব। আর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সব কিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে তারা কোথায় যাবে? মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর সেখানকার সরকার ও সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা সত্ত্বেও এই গণহত্যাকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে চীন, রাশিয়া ও ভারত। সেখানে আমরা সম্ভবত খুব অসহায় বোধ করেছি। আর তাই এই আত্মসমর্পণ।

 

http://www.dailysangram.com/post/310112