২ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:০৬

মধুখালী-মাগুরা নতুন রেলপথ নির্মাণ

পরামর্শকেই ব্যয় ৩১ কোটি টাকা

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে মাগুরা জেলার মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে এক হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। সরকারি তহবিলের অর্থে প্রস্তাবিত এ প্রকল্পে পরামর্শক খাতেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এবং স্থানীয় পরামর্শকদের জন্য এত টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। বৃহস্পতিবার প্রকল্পটির ওপর অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ প্রশ্ন তুলে ধরা হয়। এর জবাবও দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এদিকে যে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরামর্শক সেবার নামে যোগসাজশ করে অযৌক্তিক ব্যয় যাতে না হয় এবং অপরিহার্য ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি।

কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. নজরুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, পরামর্শক খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের বিষয়ে সভায় আলোচনা করা হয়। এ সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্ভাব্যতা যাচাই, ডিজাইন প্রণয়ন ও সুপারভিশনের কাজের জন্য পরামর্শক প্রয়োজন রয়েছে। এটি বাস্তবতার আলোকেই প্রস্তাব করা হয়েছে বলে দাবি করে। তাদের ব্যাখ্যা থেকে মনে হয়েছে, সাধারণত প্রকল্প হাতে নেয়ার আগেই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু এ প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে প্রকল্প অনুমোদনের পর। তাই প্রথম দিকে পরামর্শক ব্যয় বেশি মনে হলেও শেষ পর্যন্ত পরামর্শক খাতে প্রস্তাবিত ব্যয়ই রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১০ শতাংশের অনেক নিচেই রয়েছে। তাই সবকিছু মিলে আর আপত্তি করা হয়নি।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিজাইনের মতো কাজে পরামর্শক অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে অযৌক্তিক ব্যয় যাতে না হয় এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে যাতে পরামর্শক ব্যয় করা না হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন প্রকল্পে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যোগসাজশ থাকে। ফলে পরামর্শক ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনকে আরও সতর্ক হতে হবে। সেই সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে সঠিক ব্যয়ে সঠিক সেবা পাওয়া যায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, ১৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ২৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ, ৭২২ মিটার ব্রিজ তৈরি, তিনটি স্টেশনে সিগন্যালিং কার্যক্রম এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য পূর্ত কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৮৭০ সালে গড়াই নদীর ওপর সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি তা গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের বাঁশ, বেত ও পাট বহনের গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি কালুখালী থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করা হয়। একই সময়ে আরও একটি শাখা লাইন মধুখালী থেকে কামারখালী ঘাট পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল। এ সময় লাইনটি এলাকার মানুষের কাছে লাইফ কোড হিসেবে চিহ্নিত ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই শাখাটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সে লক্ষ্য পূরণে মাগুরা জেলাকে নতুন করে রেল সংযোগের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মাগুরা জেলার সঙ্গে বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্প্রসারণ ঘটবে। এসব বিবেচনায় ২০১৮ সালের জুন থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পা কমিশনে।

সভায় যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এনজিওকে সাব-কন্সালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়ন এবং এ খাতে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা ও নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। তাছাড়া ক্রয় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পণ্য ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে একাধিক পদ্ধতির পরিবর্তে যে কোনো একটি পদ্ধতি উল্লেখ করার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়ার পর তা অনুমোদনের প্রক্রিয়া হিসেবে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সভায় যেসব সুপারিশ দেয়া হয় সেগুলো প্রতিপালন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করে পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে হয়। তারপর সব ঠিকঠাক থাকলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে।

২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় দেশের প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশনা দেন। এরপর মাগুরা জেলার সংসদ সদস্যের আধাসরকারি পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এ রুটে নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/12/02/176423