২ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:০৫

ভাতার তালিকায় দেড় শতাধিক মৃত ব্যক্তি

অবৈধপন্থায় অর্থ উত্তোলন ও ভাগাভাগি

বাবুগঞ্জের মাধবপাশা ইউনিয়নের পূর্ব পাংশা গ্রামের কাজেম জোমাদ্দারের স্ত্রী ছফুরা খাতুন ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। দরিদ্র বিধবা হিসেবে সরকারের ভাতাভোগী ছিলেন তিনি। (বই নং-৩০৪৫, হিসাব নং- ০৩২১১২০১০০৯৭২)। বড় ভাইয়ের স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ছফুরা খাতুনের দেবর আক্কেল জোমাদ্দার। অথচ এই ছফুরা খাতুনের নামে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের বাবুগঞ্জ শাখা থেকে তোলা হয়েছে বিধবা ভাতা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। যদিও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না আক্কেল জোমাদ্দার। কে বা কারা ভাতা তুলছে, সে ব্যাপারেও কিছু জানা নেই তার। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন বাবুগঞ্জের মাধবপাশা ইউনিয়নের মেঘিয়া গ্রামের হাচেন বেপারীর স্ত্রী ফুলবানু বেগম। দরিদ্র বিধবা হিসেবে সরকারের ভাতাভোগী ছিলেন তিনিও। শাশুড়ির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলবানু বেগমের ছেলের বউ আলেয়া বেগম। মৃত্যুর পরও ফুলবানু বেগমের নামে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের বাবুগঞ্জ শাখা থেকে তোলা হয়েছে বিধবা ভাতার টাকা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা সমাজসেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা। যদিও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না আলেয়া বা তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। এরকম এক-দু’জন নয়, দেড় শতাধিক ব্যক্তি মারা যাওয়ার পরও তাদের নাম রয়েছে সরকারি ভাতাভোগীর তালিকায়। বিভিন্ন সময়ে তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টরা আবেদন করলেও একটি চক্র তা না করে ভাতার টাকা তুলে আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার সরকারি সামাজিক সহায়তা কর্মসূচির দুর্নীতি প্রথম পর্যায়ে এ বছরের জুলাইয়ে ধরা পড়ে। ভাতাভোগীর তালিকায় বছরের পর বছর ৪৭ জন মৃত মানুষের নাম থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এ ঘটনার সুরাহা হওয়ার আগেই নতুন তথ্য বেরিয়ে আসে, সেখানে এ সংখ্যা এখন দেড় শতাধিক ছাড়িয়েছে। তাও মাধবপাশা ইউনিয়নেই। তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে পুরো উপজেলায় এ সংখ্যা হাজার ছাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, প্রায় দেড় বছর আগে এ ইউনিয়নের মারা যাওয়া বয়স্ক, বিধবা আর প্রতিবন্ধী ভাতাপ্রাপ্তদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়েছিলেন এখানকার চেয়ারম্যান (বর্তমানে সাবেক)। কিন্তু সেই নামগুলোও তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। তালিকায় নাম থাকা এসব মৃত ব্যক্তির ভাতা কারা উত্তোলন করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছে সেটিও খুঁজে দেখার দাবি জানিয়েছেন ভাতাবঞ্চিতরা। এদিকে ভাতা দুর্নীতির এসব ঘটনা খুঁজে বের করায় সেখানকার সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য ফাতেমা আক্তার লিপির ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।

বাবুগঞ্জের মাধবপাশা ইউনিয়নে মৃত ব্যক্তিদের নামে বছরের পর বছর সরকারের সামাজিক সহায়তা কর্মসূচির ভাতা উত্তোলনের বিষয়টি প্রথম সবার সামনে তুলে ধরেন ইউপি সদস্য ফাতেমা আক্তার লিপি। তিনি তার ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের এরকম ৪৭ জনের নাম খুঁজে বের করেন, যারা বিভিন্ন সময়ে মারা গেলেও তাদের নামে তোলা হচ্ছিল বয়স্ক, বিধবা আর প্রতিবন্ধী ভাতা। এদের মধ্যে ২০১১ সালে মারা যাওয়া লোকজনও রয়েছেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহমুল হাসিব বলেন, ‘অধিদফতরের নির্দেশে সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামানকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ভাতাভোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চাওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে। ওই তথ্য পাওয়ার পর বোঝা যাবে কী পরিমাণ টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে কিংবা আদৌ আত্মসাতের কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা।’

প্রাথমিকভাবে পাওয়া এ অভিযোগের তদন্ত এ বছরের ২১ নভেম্বর শুরু হওয়ার পর তালিকায় থাকা আরও ১০৫ জন মৃত ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই ইউনিয়নের একজন সাবেক ইউপি সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ‘কেবল এই ৪৭ জন নয়, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম খান একটি তালিকা দিয়েছিলেন সমাজসেবা বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনে। এতে ভাতাভোগী ১০৫ জনের নাম ছিল যারা মৃত। এই ১০৫ জনের পরিবর্তে নতুন ১০৫ জনের নামও দিয়েছিলেন তিনি, যাদের নতুন ভাতাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ করেন। কিন্তু তা করা হয়নি। অহিদুল ইসলাম খান তালিকা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, ‘মারা যাওয়ার বহু বছর পরও ভাতাভোগী হিসেবে এদের নাম ছিল তালিকায়। ইউনিয়নজুড়ে খোঁজ নেয়ার পর ওই তালিকাটি তৈরি করে সমাজসেবা বিভাগে দেয়া হয়। তবে এরপর কী হয়েছে, তা জানি না।’ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহমুল হাসিব বলেন, ‘মাত্র ৪ মাস আগে আমি এ উপজেলায় যোগদান করেছি। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই।’ ওই ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান বলেন, ‘সাবেক চেয়ারম্যান তালিকা দিলেও সেটি কার্যকর হয়নি। ওই সব মৃত ব্যক্তির নাম এখনও রয়েছে তালিকায়। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে ইউপি সদস্য ফাতেমা আক্তার লিপির দেয়া নামগুলো।’ পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন ইউপি সদস্য বলেন, ‘লিপি যে তালিকা দিয়েছেন তাতে কেবল ৩টি ওয়ার্ডের মৃত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যানের দেয়া ওই তালিকায় এই ৪৭ জনের নাম নেই। তাছাড়া ১০৫ জনের তালিকা দেয়ার পর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হলে এ ইউনিয়নে মারা যাওয়ার পরও ভাতাভোগীর তালিকায় থাকা লোকের সংখ্যা ২শ’ ছাড়িয়ে যাবে।’

হিজলা গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, নানা কারণে মারা যাওয়ার পরও নাম পরিবর্তন হয় না ভাতাভোগীর। এক্ষেত্রে টু-পাইস আয়েরও একটি বিষয় রয়েছে। ভাতাভোগী কেউ মারা গেলে তা কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু ভাতার টাকা থেকে ভাগ পাওয়ার কারণেই বছরের পর বছর মৃত ব্যক্তির নাম তালিকায় রেখে দেয়া হয়। পুরো বিষয়টির সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি চক্র। ব্যাংকের লোক থেকে শুরু করে এ চক্রে আছেন সরকারি কর্মকর্তাও। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার এক বোনও জড়িত। তদন্ত করলেই ভেতরের এ দুর্নীতি বেরিয়ে পড়বে।

সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহমুল হাসিব বলেন, ‘কি হয়েছে বা না হয়েছে এখনই বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া ব্যাংকের হিসাব দেখলেই বোঝা যাবে যে সরকারের কি পরিমাণ টাকা লোপাট হয়েছে। ইনফ্যাক্ট এও হতে পারে যে, মারা যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে কোনো টাকাই তোলা হয়নি।’ মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজসেবা বিভাগে তথ্য দেয়ার দায়িত্বে থাকা মাধবপাশা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন হাওলাদার বলেন, ‘এ নিয়ে তো পত্রিকায় লেখালেখি হওয়ার মতো কিছু নেই। লিপি মেম্বার আমাদের কাছে একটি তালিকা দিয়েছেন। বিষয়টি আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। সত্যি হলে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে।’ মেম্বার তালিকা দেয়ার পর যাচাই-বাছাই শুরু হল, অথচ তালিকায় ৪-৫ বছর আগে মারা যাওয়া লোকজনের নামও আছে। তাছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান ১০৫ জনের একটি তালিকা দিয়েছিলেন। বছরের পর বছর এভাবে মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকায় কিভাবে থাকছে- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতের কথা বলতে পারব না। তবে আমরা নতুন করে তালিকা করছি। খুব শিগগিরই তা সমাজসেবা বিভাগে জমা দেয়া হবে।’

এদিকে ভাতা দুর্নীতির এসব ঘটনা সবার সামনে আনা ইউপি সদস্য ফাতেমা আক্তার লিপির ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ২০ নভেম্বর ভাতা দুর্নীতি বিষয়ে দৈনিক যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলে পরদিন ২১ নভেম্বর তা তদন্তে সংশ্লিষ্ট এলাকায় যান উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাসহ অন্যান্য লোকজনের সামনেই লিপির ওপর হামলা চালায় সুবিধাভোগী চক্রের সদস্যরা। তারা তাকে মারধর করে। পরে গ্রামবাসী ছুটে এসে তাকে রক্ষা করেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিপি আক্তার একটি লিখিত অভিযোগ দিলে তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিমানবন্দর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠান ইউএনও সাঈদুজ্জামান খান। বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অভিযোগের তদন্ত চলছে। সত্যতা পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/12/02/176420