২ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১০:০০

হযরত মুহাম্মদ (সা) সকল মানুষের নবী

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম মহান আল্লাহর শেষ পয়গাম্বর। খাতামুন নাবীঈন। তাঁরপর আর কোনও নবী বা রসুলের আবির্ভাব ঘটবে না। তিনি কেবল মুসলিমদের নবী নন। পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতিরও নবী তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, শুধু আরব দেশ নয় নিজবংশ কুরাইশদের বিরোধিতারও মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। কিন্তু কেন? শৈশব থেকেই যিনি সবার কাছে আল আমিন বা বিশ্বাসী বলে পরিচিত ছিলেন; তিনি কালেমার দাওয়াত দেবার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে যাবার কারণ কী? আরবের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ এই বিশ্বাসী লোকটির বিরুদ্ধে চলে গেল কেন?

আল্লাহর দীন বিকৃত করতে করতে মানুষ শেষ অবধি পৌত্তলিকতায় ভরে ফেলে। এমনকি বাইতুল্লাহ তথা আল্লাহর ঘরেও ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপন করে মক্কার বিভ্রান্ত কুরাইশ জাতি। বিস্মৃত হয়ে পড়ে তওহিদ। আল্লাহর ঘর কা'বায় মূর্তিস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে কুরাইশদের মনের মণিকোঠায়ও স্থান করে নেয় মাটির পুতুল। ক্ষমতা আর লিপ্সা জেঁকে বসে সেখানকার সরদার ও গোত্রপ্রধানদের হৃদয়ে। মানবতা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, মানুষের কল্যাণচিন্তা বিদায় নেয় আরবসমাজ থেকে। ধরো, মারো, ক্ষমতা দখল করো যেকোনওভাবে। সন্ত্রাস আর অরাজকতায় ছেয়ে যায় সমাজ ও সভ্যতা।

সমাজের শান্তি ফেরাতে, মানুষগুলোকে সভ্য করে গড়ে তুলতে, সবার মনে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে, দুস্থদের মুখে হাসি ফোটাতে, সমাজের ছোটখাটো সমস্যা মিটিয়ে দিতে উদ্যোগী হন কিশোর মুহাম্মদ (সা)। গঠন করেন হিলফুল ফুজুল নামে স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন। সংগঠনটির কাজ দেখে সবাই বেশ খুশিও হয়।
সেসময় আরব দেশে মারামারি, কাটাকাটি আর ক্ষমতার লড়াই নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়। মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সব। নারীদের মান-ইজ্জত নিয়ে চলে জুয়াখেলা। মুহাম্মদ (সা) শৈশবকাল থেকেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতপ্রিয় কুরাইশদের নানা সমস্যা সমাধানের সুরাহা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। সফলকামও হন। এরপরও গোত্রপ্রধানদের কোপানলে পড়তে হয় তাঁকে।

জন্মভূমি মক্কায় বসবাস করা মুহাম্মদের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে ধীরেধীরে। কারণ তিনি যে কালেমার দাওয়াত দিচ্ছেন, নির্ভেজাল তওহিদের প্রচারণা চালাচ্ছেন তা সেখানকার সরদার, গোত্রপতি কেউ মেনে নিতে পারছে না। দুই-একজন করে দীনের দাওয়াত গ্রহণ করলেও কুরাইশ নেতারা প্রায় সবাই মুহাম্মদ (সা) এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। যেকোনও মূল্যে তারা মুহাম্মদকে প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর হয়।
আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির পর হযরত মুহাম্মদ (সা) কালেমা তথা তওহিদের দাওয়াত দেবার সঙ্গেসঙ্গে মক্কার কুরাইশরা বিরুদ্ধে চলে যায়। লিপ্ত হয় নানা ষড়যন্ত্রে। বিভিন্নভাবে নির্যাতন পর্যন্ত শুরু করতে থাকে। তাই এক পর্যায়ে আল্লাহর নবী (সা) কে মক্কা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার পরিকল্পনা করতে হয়। একে বলে হিজরত।
দীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে যখন প্রিয় জন্মভূমি মক্কায় অবস্থান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো তখন তিনি সেখান থেকে মদিনায় হিজরত করেন। সুখের বিষয় যে, মদিনায় তিনি বিপুলভাবে সম্বোর্ধিত হন। সেখানকার মুসলিমরা রসুলুল্লাহ (সা) কে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। তবে মদিনাতেও রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। যুদ্ধও করতে হয়েছে তাঁকে। তবে সব বাধা ও বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি মদিনার রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয় মদিনাকে তিনি সকলের জন্য কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন।

অতঃপর এক পর্যায়ে তিনি বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। প্রতিষ্ঠা হয় আল্লাহর দীন। সেসময়কার সারা দুনিয়ায় দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেন। কয়েকজন শাসককে আহ্বান জানান কালেমা তাইয়েবা পাঠের। এরপর দাওয়াতপ্রাপ্তরা সবাই ইসলামকে স্বাগত জানিয়েছেন এমন নয়। তবে তিনি দুনিয়ার সকল মানুষকে এর পতাকাতলে সমবেত হবার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। ইসলামের কল্যাণ কেবল মুসলিমরাই উপভোগ করবেন এমন নয়। সূর্যের আলো যেমন সবাই ভোগ করেন, বাতাস যেমন মুসলিমরাই উপভোগ করেন না, তেমনই আল্লাহর দীন ইসলামও সবার জন্য উন্মুক্ত।

সূর্যের কল্যাণময় আলো থেকে পালিয়ে কেউ যদি পাহাড়ের অন্ধকার গুহায় গিয়ে লুকিয়ে থাকে তাহলে সূর্যালোকের কী দোষ? ঠিক তেমনই ইসলামের কল্যাণকর মহান আদর্শ থেকে স্বেচ্ছায় কেউ দূরে সরে থাকলে এ নিয়ামতের অপরাধ কোথায়? অবশ্য মুসলিমদের কেউ কেউ সাময়িক এবং ক্ষণস্থায়ী সুবিধের জন্য স্বার্থান্ধ হয়ে ইসলামের গায়ে কালিমা লেপন করেছে। এজন্য দায়ী অপরিণামদর্শী হতভাগ্য কতিপয় মুসলিম। এতে ইসলামের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। তথাকথিত মুসলিমদের অন্যায় ও অপরাধের জন্য ইসলাম দায়ী হবে কেন?
উল্লেখ্য, হযরত ইব্রাহিম (আ) এর দীনও ছিল ইসলাম। কুরআনের আলোকে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা ছিলেন মুসলিম বা আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণকারী। অনেকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে প্রচার করেন যে, তিনি ছিলেন ইহুদি। কিন্তু এটা সত্য নয়। হযরত ইব্রাহিম (আ) কে মুসলিমজাতির পিতা বলা হয়। তিনি ইহুদি বা খৃস্টান হলে তাঁকে মুসলিমজাতির পিতা বলা হবে কেন?
হযরত মুহাম্মদ (সা) এর কথা পূর্বেকার প্রায় সব আসমানি কিতাবেই সম্মানের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। এমনকি ভারতীয় মানবপ্রণীত ধর্মগ্রন্থাদিতেও মুহাম্মদ (সা) এর মহান নাম মর্যাদা সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় আখিরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) সব মানুষের নবী। কুরআন নাযিল হবার পর আগেকার সব আসমানি কিতাব যেমন রহিত হয়ে গেছে, তেমনই সব দীনও স্থগিত হয়েছে। আগেকার কিতাবসমূহ বাতিল। নবীরা বাতিল। আগের দীন বা আদর্শও বাকি থাকলো না। অতএব মানবপ্রণীত ধর্মাদর্শ সবার মানবার বা অনুসরণেরতো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই দীন বলতে সকলের জন্য কেবল ইসলাম নির্ধারিত হলো। আসমানি কিতাব বলতে কুরআন ছাড়া আর কোনও একটিও নিখুঁত বা অবিকৃত নেই। এই কুরআনই এখন সবার গ্রহণীয় ও মান্য।

অনেকে মনে করেন আল্লাহ, রসুল, কুরআন, ইসলাম এসব কেবল মুসলিমদের নিজস্ব বিষয়। ভুলের সৃষ্টি এখানেই। আলো, হাওয়া, খাদ্য-পানীয়, চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, পৃথিবীর সৌন্দর্যরাজি, নদী-নালা, বৃক্ষলতা, মেঘের ছায়া যেমন সবার জন্য; ঠিক তেমনই আল্লাহ, তাঁর রসুল (সা), আল কুরআন, ইসলাম এসব শুধু মুসলিমদের নয়। এগুলো সব মানুষের জন্য। তাই সবার রব আল্লাহ। মুহাম্মদ (সা) সবার নবী, কুরআন সব মানুষের হিদায়াতগ্রন্থ, ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জন্য একমাত্র উত্তম আদর্শ। এ আলোকে সমাজ পরিচালিত হলে মানুষে মানুষে বিভেদ, বিবাদ ইত্যাদি থাকবার কথা নয়। মুলত মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচিয়ে সমাজে সুন্দর, স্বাভাবিক ও সৌভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন রচনা করতেই রসুলুল্লাহ (সা) এর শুভাগমন ঘটেছিল।

http://www.dailysangram.com/post/309788