১ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৯:৩১

এমপিও পেতে ঘাটে ঘাটে ঘুষ

বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও পেতে ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। স্কুল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ৫-৬টি ধাপে ১০ হাজার থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের এমপিও পেতে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে মাউশির উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত দল। ময়মনসিংহে আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে দুই দফা তদন্তে বিস্তর দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি। আর ঢাকার উপ-পরিচালককে দুর্নীতির অভিযোগে দুই দফা বদলির নির্দেশ দিলেও সরানো যায়নি। ২০১৫ সালে সারা দেশের এমপিও ৯টি আঞ্চলিক অফিসে বিকেন্দ্রীকরণ করার পর শিক্ষক হয়রানি, ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ।

এরপর এমপিও ফের কেন্দ্রীয়ভাবে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছু হটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আঞ্চলিক অফিসের ডিডিদের কয়েক কোটি টাকার ফান্ডের কাছে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য জানান, এক জায়গার দুর্নীতি এখন ৯ জায়গায় পাঠানো হয়েছে। মাউশির দুর্নীতি এখন স্কুল, উপজেলা, জেলা, আঞ্চলিক অফিস, মাউশি এবং মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছেছে। এমপিও পেতে এখন ৬ ঘাটে ঘুষ দিতে হয় শিক্ষকদের। তদন্ত কমিটির একজন সহকারী পরিচালক জানান, সম্প্রতি একটি আঞ্চলিক অফিসে সরজমিন তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। শিক্ষকরা জানান, স্কুল থেকে ফাইলপত্র তৈরিতে প্রথমে নিম্নমান সহকারী, এরপর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ে ঘুষ দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে। টাকা দিলেই অনলাইনে ফাইল পাঠানো হয়। নইলে নানা কারণ দেখিয়ে ফাইল আটকে দেয়া হয়। এমপিও (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) বিকেন্দ্রীকরণের পর আগের চেয়ে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড ও নানা বিষয় সংশোধনেও দিতে হয় ঘুষ। আঞ্চলিক অফিস এমপিও না দিলে যেতে হয় মাউশিতে। সেখানে হয়রানি। কখনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সে জায়গায় টাকা দিতে হয়। অর্থাৎ টাকা ছাড়া এমপিও ফাইল এক চুলও নড়ে না।
এ ব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক ড. প্রফেসর এস এম ওয়াহিদুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, দুর্নীতি, ভোগান্তি কমানোর জন্য এমপিও প্রক্রিয়া অনলাইন ও বিকেন্দ্রীকরণ করা হলো। এরপরও যদি দুর্নীতি, অনিয়ম বাড়ে তাহলে কোথায় যাবো আমরা? এটি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ভাবতে পারেন। তিনি বলেন, অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ আমার কাছেও আসে। সেগুলো তাৎক্ষণিক ভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলি। ব্যবস্থা হয় কিনা বাকিটা নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের ভালো জানার কথা।

কেস স্টাডি-১: রাঙ্গামাটির রাঘাইছড়ি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক প্রতিবিন্দু চাকমা। তার নিয়োগের সব কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও চারবার এমপিও দেয়নি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিস। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত করতে যান মাউশির মনিটরিং শাখার পরিচালকের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি। ওই শিক্ষক জানান, ওই অফিসের প্রোগ্রামারের চাহিদা মতো টাকা না দেয়ায় আমার এমপিও দেয়া হয়নি। তিনি জানান, আঞ্চলিক অফিস পর্যন্ত আসার আগ পর্যন্ত তিন জায়গায় ঘুষ দিতে হয়েছে। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, চারবার আবেদনের পর এমপিও বাতিল হয় ওই শিক্ষকের।

তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, ওই শিক্ষক প্রথম ধাপে স্কুল তারপর বাঘাইচড়ি উপজেলার মাধ্যমিক অফিসারকে দশ হাজার টাকা দেয়। এরপর জেলা ম্যানেজ করার পর আঞ্চলিক অফিস তার এমপিও আবেদন চারবার বাতিল করে। তদন্ত কমিটির কাছে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন উপ-পরিচালক। তার জন্য প্রোগ্রামার মামুনুর রহমানকে দায়ী করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, ওই প্রোগ্রামার নিজেকে কখনো চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন মন্ত্রীর আত্মীয়, কখনো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীর আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। এই অফিসে পরিচালক, উপ-পরিচালক কাউকে পাত্তা দেন না তিনি। ওই অফিসে সে নিজেই সব এসব বলে বেড়ান। আমি না চাইলে এখানে কারও এমপিও দেয়ার ক্ষমতা নেই। শুধু তাই নয়, ওই প্রোগ্রামার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাসওয়ার্ড জোরপূর্বক ব্যবহার করে অনিয়মের মাধ্যমে এমপিও দিতেন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু বলতেই ওই অঞ্চলের একজন মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানো শুরু করেন। তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে অফিসিয়ালি সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও খাবার টেবিলে তাদের ম্যানেজ করতে নানা ধরনের অফার দেন। তদন্ত রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, মামুুনুর রহমানের দুর্নীতি ও হয়রানির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন কবিরহাট কলেজ, নাজিরহাট, হাটহাজারীসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক কলেজের অধ্যক্ষ। মামুনুর রহমান ছাড়া এমপিও হয় না এ রকম একটি বিজ্ঞাপন ওই এলাকায় লাগানো হয়েছে। ওই অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ গোলাম ফারুক, উপ-পরিচালক আজিজ উদ্দিনও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করেছে কমিটি।
কেস স্টাডি-২: শেরপুরে বাকাকুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের কম্পিউটারের সহকারী শিক্ষক মাহবুবুর রহমান। মাউশির মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, এমপিওর জন্য আবেদন করার পর আঞ্চলিক অফিস থেকে নৈশপ্রহরী নূর হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয় অফিস থেকে। নূর হোসেনের সঙ্গে আড়াই লাখ টাকায় চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, এমপিওর আগে দেড় লাখ টাকা, কাজ শেষে বাকি এক লাখ টাকা দেয়া হবে। পরপর তিনবার তার এমপিও বাতিল হওয়ার পর নৈশপ্রহরীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে দেখা দেয় না। বাধ্য হয়ে উপ-পরিচালকের কাছে গেলে শিক্ষককে পুলিশের কাছে দেয়ার হুমকি দেন তিনি। এরপর বাধ্য হয়ে তিনি মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। ওই শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, আমি জমি বন্ধক দিয়ে এই টাকা জোগাড় করেছি। এখন পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।

কেস স্টাডি-৩: গাইবান্ধা সদর উপজেলার একটি স্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মাসুদুল হক। সেপ্টেম্বর মাসে মাউশির কাছে লিখিত অভিযোগে করে জানান, রংপুর আঞ্চলিক অফিস থেকে আমার এমপিও হওয়ার পর জেলা শিক্ষা অফিস আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। তাদের চুক্তি অনুযায়ী বাকি ৪০ হাজার টাকা না দেয়ায় জেলা অফিস থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে বাকি টাকা দেয়ার চাপ দেন। শিক্ষক জানান, এমপিও পেতে ইতিমধ্যে আমার তিন লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। বাকি টাকা দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। এরপর তাকে রুমে আটকে রেখে পরিবারের কাছে ৪০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। না হলে তার বিরুদ্ধে উল্টো রিপোর্ট দেয়ার হুমকি দেন ওই অফিসের অফিস সহকারী। ওই শিক্ষকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রংপুর আঞ্চলিক অফিসকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলে মাউশি।

কেস স্টাডি-৩: ময়মনসিংহ সদরের মাইজবাড়ি আবদুল খালেক উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক সায়মা নিলুফা। ২০১৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পেলেও আজ অবধি তার এমপিও হয়নি। তার এমপিও না দেয়ার জন্য সরকারের একটি পরিপত্রকে অজুহাত করছেন উপ-পরিচালক। তার নিয়োগের আগেই ওই পরিপত্র হয়েছে এমন প্রমাণসহ মাউশির মহাপরিচালকের আবেদন করেন। তখন তার এমপিওর সঙ্গে আরো ৫০ জনের একটি তালিকা পাঠান মাউশিতে। মাউশির চিঠির প্রেক্ষিতে ওই শিক্ষিকার সঙ্গে আরো ৫০ জনের এমপিওর জন্য চিঠি দেন। অভিযোগ উঠেছে, একজনের অজুহাতে আরো ৫০জনকে এমপিও দেয়ার নামে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করা তার স্ত্রী ও ব্যক্তিগত সহকারীর (এপিএস)। আগস্ট মাসে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রমাণ পায়। সেই তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করে পূর্ণ তদন্তের আবেদন করেন ওই উপ-পরিচালক। এরপর মাউশির পরিকল্পনা শাখা পরিচালকের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্তে তার অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। তাকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে সম্প্রতি অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু ওই উপ- পরিচালককে বদলি করা হয়নি। চাউর আছে, মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে মাউশিতে প্রচুর টাকা ঢালেন তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=94429