৩০ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৭

৫৭ ধারা বিলুপ্ত হচ্ছে শঙ্কা থাকছেই

অনলাইনজগতে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হচ্ছে। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এই স্বস্তির খবর শুনিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
তবে শঙ্কার মেঘ উড়িয়ে নিতে পারছে না এ খবর। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৭’-এর যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় আলোচিত বিষয়গুলোও রাখা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে তা ৫৭ ধারার মতো যথেচ্ছ ব্যবহার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সার্বিকভাবে ডিজিটাল অপরাধগুলোর প্রতিকার, প্রতিরোধ, দমন ও বিচারের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। ৫৭ ধারায় আলোচিত ‘মানহানি’, ‘মিথ্যা-অশ্লীল’, ‘আইন-শৃঙ্খলার অবনতি’ ও ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ ইত্যাদি বিষয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চূড়ান্ত খসড়ায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রস্তাবিত এ আইনের প্রাথমিক খসড়ায় এসব বিষয় ১৯ ও ২০ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গতকালের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়েকটি স্তরে শাস্তি বা কারাদণ্ডের বিধান রাখা হবে। তবে প্রস্তাবিত আইনে সংবাদকর্মীদের বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলা নেই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্তকরণে গতকাল আইন মন্ত্রণালয়ে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এতে সভাপতিত্ব করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই আইনমন্ত্রী জরুরি কাজে বৈঠক ছেড়ে যান। তবে যাওয়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য বসেছিলাম। সাংবাদিকদের উদ্বেগের বিষয় আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা যেভাবে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা সেভাবে থাকছে না।

জনগণের বাক্স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যেসব চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের দরকার, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও সম্প্রচার আইনেও থাকতে পারে। ’
বৈঠক শেষে তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করেছি। সংবিধানে প্রদত্ত সব ধরনের মৌলিক অধিকার এবং সংবিধানের যেসব গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি আছে, সেগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এ আইন করা হচ্ছে। এ আইন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করবে। পাশাপাশি ডিজিটালজগেক নিরাপত্তা দেবে এবং সেটির বিকাশে সাহায্য করবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর আশা করছি আগামী শীতকালীন অধিবেশনে জাতীয় সংসদে এটি উত্থাপন করতে পারব। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে তার সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হবে। ’
গতকালের বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
৫৭ ধারা নিয়ে বিশেষ করে বেশি উদ্বেগ ছিল সাংবাদিকদের। এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এখানে এটা কোনো ব্যাপার নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ১৬ কোটি মানুষের জন্য করা হচ্ছে। এখানে সাংবাদিকদের জন্য আলাদা বিষয় নয়। নতুন এই আইন নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। অপরাধের ধরন দেখে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সাজার মেয়াদ রাখা হয়েছে।
গত বছরের ২২ আগস্ট ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর এই খসড়ার কয়েকটি ধারা নিয়েও আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মতো বিতর্ক শুরু হয়। পরে আইনমন্ত্রীকে প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০০৬ সালে আইসিটি আইন প্রণীত হওয়ার পর ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুইবার সংশোধন হয়। ২০১৩ সালে এতে ৫৭ ধারা যোগ করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী ৫৭ ধারায় শাস্তির মেয়াদ করা হয় কমপক্ষে সাত বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। পাশাপাশি অর্থদণ্ডের ব্যবস্থাও রয়েছে।

৫৭ ধারায় যা আছে : বর্তমানে বহাল আইসিটি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)-এর ৫৭ ধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ফরম বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন কিংবা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এই ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে অপরাধ। ’
এ আইনের ধারা-২-এর ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘ইলেকট্রনিক বিন্যাস অর্থ কোনো তথ্যের ক্ষেত্রে কোনো মিডিয়া, ম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল, কম্পিউটারে স্মৃতি, মাইক্রোফিল্ম, কম্পিউটারে প্রস্তুতকৃত মাইক্রোচিপ বা অনুরূপ কেনো যন্ত্র বা কৌশলের মাধ্যমে কোনো তথ্য সংরক্ষণ বা প্রস্তুত, গ্রহণ বা প্রেরণ। ’
প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রাথমিক খসড়ার ১৯ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা (মানহানি) মতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি ঘটায় তা হবে একটি অপরাধ। (২) উপধারায় বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কোনো কিছু প্রকাশ করে বা সম্প্রচার করে, যা মিথ্যা ও অশ্লীল এবং যা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে, তাহলে তা হবে অপরাধ। উপধারা-৩-এ বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যা কেউ পাঠ করলে বা দেখলে বা শুনলে তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে তা হবে একটি অপরাধ।

ওই খসড়ার ২০ ধারায় বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে যা পড়লে, দেখলে বা শুনলে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার ভাব বর্ধন করে বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয় তবে তা হবে একটি অপরাধ।
জানা গেছে, গতকালের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা একমত হয়েছেন যে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় যে শাস্তির বিধান রয়েছে (১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা সে রকম থাকবে না। এই আইনে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কয়েকটি স্তরে শাস্তির বিধান করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোনো অপরাধের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া যাবে অপরাধীদের।
প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও সাংবাদিকদের হয়রানির সুযোগ থাকছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য আইনে কোনো বিশেষ সুযোগ থাকে না। কারণ আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। তবে আইনের যাতে অপব্যবহার না হয় সে জন্য আইনেই বিধান রাখা উচিত।

তথ্য-প্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ৫৭ ধারা কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মূলত মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সাজার মেয়াদ হয়তো কমানো-বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু দমন-পীড়ন ৫৭ ধারার মতো এ আইনেও একইভাবে চলার আশঙ্কা থাকছে। এমনভাবে আইনগুলো করা হচ্ছে যা নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং বাক্স্বাধীনতার পরিপন্থী। সাধারণ আইনে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা বা বিভিন্ন অরাধের শাস্তি এমনিতেই আছে, সে ক্ষেত্রে নতুন করে আইন করার দরকার নেই। এ অবস্থায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ৫৭ ধারার মতো একই রকম বিধান রেখে নতুন আইন করার মানেই হচ্ছে দমন-পীড়ন চলবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/11/30/571838