৩০ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩

অন্যের ত্রুটি নিজের সান্ত্বনা হতে পারে না

গত ২৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্য দেশেও গুম হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, যুক্তরাজ্যে ২০০৯ সালে ২ লাখ ৪৫ হাজার ব্রিটিশ নাগরিক গুম হয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজারের হদিস পাওয়া যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এ পর্যন্ত সরকার গুমের কথা অস্বীকার করে এলেও এখন প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করলেন দেশে গুম হয়। গুম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের দায় এড়াতে পারেন না। অন্যত্র ঘটা গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অজুহাত দেখিয়ে নিজ দেশে তা ঘটতে দেয়া মোটেই সমীচীন নয়।

২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত এবং ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর ‘দি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্সেস’ (আইসিপিপিইডি)-এর ১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা অন্য কোনো জনগুরুত্বসম্পন্ন জরুরি অবস্থার অজুহাতে গুমের আশ্রয় নেয়া যাবে না। কনভেনশনটির ২নং অনুচ্ছেদে গুমের আওতাভুক্ত কার্যাবলীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গুম বলতে বন্দি করা, আটক করা, অপহরণ করা বা যে কোনো ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করাকে বোঝায়, যা রাষ্ট্রের এজেন্ট বা কর্তৃপক্ষের সম্মতি, সহায়তায় একাধিক ব্যক্তি বা দল ঘটিয়ে থাকে এবং সরকার বা কর্তৃপক্ষ এরূপ কার্যাবলীর দায়ভার অস্বীকার করে। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তি বঞ্চিত হয় আইনের রক্ষাকবচ থেকে।

বাংলাদেশের সংবিধানে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আইনের আশ্রয় লাভের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ সংক্ষেপে এর অর্থ হল, জানমালের নিরাপত্তা জনগণের সাংবিধানিক অধিকার।

আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের প্রতি বুড়ো অঙ্গুলি প্রদর্শন করে ঘটানো হচ্ছে গুম ও বিচারবহির্ভূত খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ ও অন্য সূত্রের বরাত দিয়ে এ বছরের ৩০ আগস্ট যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ বছরে সারা দেশে নিখোঁজ ৬১৮ জনের মধ্যে পুলিশ ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। অপহরণের পর ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়েছেন ৫১ জন। দীর্ঘদিন পর পুলিশ ১১ জন, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যা ব ৩৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে। বিভিন্ন পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচজনকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। বাকি ৪৬৯ জনের হদিস মেলেনি আজও। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম আট মাসে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি। এর মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ৭ জনকে। লাশ মিলেছে ২ জনের। পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৩ জনকে। বাকি ৩৩ জন কোথায় তা আজও জানতে পারেনি তাদের স্বজনরা। এরপরও গুমের কাতারে শামিল হয়েছেন অনেকে।

এর আগে ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট যুগান্তরের আরেক রিপোর্টে বলা হয়, জাতিসংঘে গুম ও অপহরণবিরোধী কমিটি বাংলাদেশের ১৫০টি ঘটনা কেইস স্টাডি আকারে গ্রহণ করেছে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৫০ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ জাতিসংঘের গুমবিরোধী কমিটিকে অবহিত করেছে। ওই বছর ৩১ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ২২৯ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তারা হলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম, সিলেটের সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী, লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দেল, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যুবক সাজেদুল ইসলাম সুমন, এমএ আদনান, আবদুল কাদের ভুঁইয়া, মাসুম, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আসাদুজ্জামান রানা, জাহিদুল করিম তানভীর ও আল আমীন।

বাবা মারা গেলে সন্তান কবরের পাশে গিয়ে জিয়ারত করে। বাবার আত্মার শান্তির জন্য স ষ্টার কাছে প্রার্থনা জানায়। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া বাবাদের সন্তানেরা জানে না তাদের বাবা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। তাদের কান্নার শেষ নেই। গুম হয়ে যাওয়া পারভেজ হোসেনের ছোট্ট মেয়ে আদিবা ইসলাম, খালিদ হোসেন সোহেলের শিশুপুত্র আরিয়ান, হুমায়ুন পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবিরসহ অনেকের কণ্ঠে এমন বেদনাবিধুর কান্না আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনদের অসহায় আর্তনাদ।

প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে গুমের উদাহরণ টেনে দেশে এমন অপকর্মের সমর্থন খুঁজতে চেয়েছেন। এটা সত্য যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে গুমের ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আটক জঙ্গিদের ক্ষেত্রে গুমের ঘটনা ঘটে। গুয়ান্তানামোয় গোপন কারাগারে রাখা বন্দিদের তালিকা যুক্তরাষ্ট্র ২০০৬ সালে প্রকাশ করেছে এবং বন্দিদের অনেকে মুক্তি পেয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে রাজনৈতিক কারণে গুমের ঘটনা ঘটলেও মাদক ও মানব পাচারে বাধাদানকারীদের অনেকে মাদক ও মানব পাচারকারী চক্রের দ্বারা গুম ও খুন হন। পশ্চিমা দেশেগুলোতে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশ্যভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ্যভাবে সংরক্ষণ তো দূরের কথা, সরকার এতদিন গুমের কথা স্বীকারই করেনি। শাসক দল আওয়ামী লীগের পরপর দুই মেয়াদে দেশে প্রথমবার গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বৃদ্ধি পেলেও সরকার গুরুতর এ বিষয়টিকে বেমালুম অস্বীকার করে আসছিল। দেশের আইনশৃঙ্খলাসহ জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত বছর নভেম্বরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দেশে গুম বলে কোনো শব্দ নেই। কেউ গুম হয়েছে এমনটি জানা নেই। যারা গুম রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা বিভিন্ন কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন।’

এদিকে প্রকাশ্য অভিযোগ উঠেছে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকার এ জঘন্য অপরাধ সংঘটনের কাজে ব্যবহার করছে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে গুম হওয়া বিএনপি নেতা হুমায়ুন পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্যের বরাত দিয়ে ২৭ নভেম্বর একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লার লাকসাম থেকে হুমায়ুন পারভেজ এবং তার রাজনৈতিক সহকর্মী সাইফুল ইসলাম ও জসিমউদ্দিন অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা যাচ্ছিলেন। পথে র্যা ব-১১-এর একটি দল কুমিল্লার হারিসপুরে অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে। একপর্যায়ে র্যা বের সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে তিনজনকে নামিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেন। পরদিন জসিমউদ্দিনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করা হলেও হুমায়ুন পারভেজ চার বছর ধরে নিখোঁজ।

অভিযোগ রয়েছে, গুম হয়ে যাওয়া কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে পুলিশ জিডি নিতে চায় না, যদি কোনো একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই গুমের সঙ্গে জড়িত বলে তার আত্মীয়স্বজনরা জিডিতে উল্লেখ করে। শেষ পর্যন্ত জিডি নিলেও মামলার তদন্ত আর এগোয় না।

গুমের অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপিত হওয়ায় এবং গুম বন্ধে দেশ-বিদেশে দাবি ওঠায় প্রধানমন্ত্রী গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথা জাতীয় সংসদে স্বীকার করেছেন। তাই এখন সরকারের কাজ হবে এ অপরাধ বন্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত আইসিপিপিইডিতে স্বাক্ষর করেনি বলে জানা যায়। বাংলাদেশের উচিত হবে অবিলম্বে আইসিপিপিইডিতে স্বাক্ষর করা। তাছাড়া, সরকার একটি বিশ্বাসযোগ্য কমিশন গঠন করতে পারে, যে কমিশন গুমের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের জন্য আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাবে এবং গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে যথোপযুক্ত সুপারিশ তুলে ধরবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

 

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/11/30/175964