২৮ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২০

মোবাশ্বারের বোনের আবেগভরা চিঠি

‘একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে বাপ বেটির এক হওয়া হলো না’

‘আমি জানি এবারও নিজের সাধ্যের মধ্যে বড় করেই আয়োজন করতো একমাত্র মেয়ের জন্যে ও। কিন্তু পারলো না। এতো মানুষের এতো কান্না, এতো অনুরোধ, কিছুতেই কিছু হলো না। একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে বাপ বেটির এক হওয়া হলো না। আমি জানি, আমার ভাই নিখোঁজ হওয়াতে কারো কিছু যায় আসে না। এতো কোটি মানুষের ভিড়ে একটা বাবার তার সন্তানের জন্যে এই দুর্বিসহ হাহাকার হয়তো খড়ের গাঁদায় সুঁইয়ের মতোই।
কিন্তু তবুও আমি একটা অনুরোধ করতে চাই...।’ ফেসবুকে আবেগঘন এক স্ট্যাটাস দিয়ে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজারের বোন তামান্না তাসনিম। গত ৭ই নভেম্বর বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আর ফিরে আসেন নি মোবাশ্বার। তার একমাত্র মেয়ে আরিয়ানার জন্মদিন ছিল আজ সোমবার। এদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি দেন তামান্না। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, নিজের সন্তান না থাকলে নাকি বাবা/মায়ের উৎকণ্ঠা বুঝা যায় না। হয়তো ... কিন্তু নিজের সন্তান থেকে দূরে থাকার যে কি যন্ত্রনা, সেটা আমার ভাইয়া কে দেখে ওর আশেপাশের সবাই বুঝতো। মেয়ের প্রতি ওর এই ভালোবাসা অন্য বাবাদের থেকে অনেক আলাদা। কারণ সে চাইলেই সবসময় মেয়েকে কাছে পেতো না। এতো সৌভাগ্য ছিলোনা ওর যে ইচ্ছা হলেই নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। আর আজ সেই মেয়ের জন্মদিনে ও কতদূরে, কোন অজানায়।... শেষবার দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আরিয়ানা কে কল দিয়ে ভাইয়া বলেছিলো ‘আম্মু, বাবা বাইরে যাচ্ছি। অনেক লম্বা জার্নি। তুমি দোয়া কোরো বাবার জন্যে, কেমন?’ আমি জানি খুব ভালো করেই এই এতটুকু কথা না বলে ফ্লাইটে উঠতে হলে ভাইয়ার জার্নি শান্তির হতোনা।

তামান্না লেখেন, আরিয়ানা একবার বলেছে ‘আব্বু ভিডিও কল দাও, তুমি কোন পনি কিনেছো আমি দেখি’! নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের কারণে ভিডিও কল কাজ করছিলো না। যতক্ষণ না ক্লিয়ার ভিডিও তে মেয়েকে দেখেছে, আমার ভাই আমার মাথা মোটামুটি খারাপ করে ফেলেছে। কারণ, যতগুলা অপশন আছে ভিডিও কল করার, সবগুলা বাবুর ন্যানিকে বুঝায় দিয়ে, ফোনে ইন্সট্রাকশন দিয়ে নামানো লেগেছিলো আমার।
যদি কখনো শুনতো বাবুর শরীর খারাপ তখন ওর অসহায়ত্বটা আরো প্রখর হয়ে উঠতো। বারবার ওর ন্যানিকে কল দিতো। বাসায়ও সেই সময়গুলাতে কারো সাথে তেমন কথা বলতো না। আমার সদা হাস্যজ্বল ভাইয়ের মুখ গোমড়া থাকলে আমি আন্দাজ করতে পারতাম যে হয় আরিয়ানার সাথে আজকে কথা হয়নি নাহলে বাবু অসুস্থ।...বাবুর জন্মদিন মানে আমাদের বাসার সবচেয়ে বড় উৎসব। গতবার ওর জন্মদিন বাইরে বড় করে করা হয়েছিল। রেস্টুরেন্ট, গেম্স্, ম্যাজিক, কেক সব ভাইয়া একা হাতে ম্যানেজ করেছিল। যেন পারলে ওই একটা দিন গোটা দুনিয়া বাবুর পায়ে এনে দেয়।

আর আজ ... বাবুর ষষ্ঠ জন্মদিনে ও কোথায়? এতদিন ও কেমন ছিল আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি আজকে ও কাঁদছে। তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে একটু রেখে কল্পনা করেন তো! বেশিনা, মাত্র ২ টা মিনিট ... পারেননি ... আমি জীবন বাজি রেখে বলতে পারি ছুঁটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমার ভাইয়ের কষ্ট কি একটু হলেও অনুধাবন করতে পারেন আপনারা এখন? তাহলে বলেন, আমার ভাইটা কেন পারবেনা তার একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে মেয়েকে কোলে নিতে? একটা ছয় বছরের অবুঝ শিশুকে কেন মিথ্যা কথা বলে ভুলিয়ে রাখতে হবে? আপনি ২ মিনিট পারেননি, সেখানে আমার ভাই ২০টা দিন ধরে তার মেয়ের থেকে দূরে আছে। এতটাই অভাগা সে যে, মেয়ের জন্মদিনে উইশ টা পর্যন্ত করতে পারলো না, আদর করে দিতে পারলো না। বলতে পারলো না ‘আম্মু, আমি তো দূরে আছি, আমার জন্যে তুমি দোআ কোরো!’ বাবুর আধো আধো কণ্ঠে ‘বাবা’ ডাকটা শুনতে পারছে না।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=93930