১৮ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২৩

বন্যায় বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা

উজানের ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর দুই মাসের ব্যবধানে আরো দু’টি বন্যায় শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নেমে এসেছে ব্যাপক বিপর্যয়। চলমান বন্যার কারণে বেশ কিছু জেলায় জুন থেকে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যত্রুম বন্ধ রয়েছে। আর চলমান বন্যায় বিপর্যয়ের মাত্রা আরো চরম আকার ধারণ করেছে। পানি ঢুকে পড়ায় বন্যাকবলিত অন্তত ২০ জেলায় প্রায় তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে কোনোটি আংশিক, কোনোটি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আসবাবপত্র, বই-খাতাসহ স্কুলের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে শিশুদের লেখাপড়া চরম বিঘ্নিত হয়েছে। কিছু জেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার্থীরা। স্কুল বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষার্থীদের ক্লাস, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। আগস্টে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা নেয়ার কথা। বন্যা পরিস্থিতি চলমান থাকলে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে এই পরীক্ষা পিছিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পাস কোর্সের তিনটি, আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাজিল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আসন্ন শিক্ষক নিবন্ধনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা স্থগিত করার দাবি করেছেন পরীক্ষার্থীরা। এদিকে বন্যার সময় শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে নানা দিকনির্দেশনা দিলেও মাঠ পর্যায়ে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছে কর্মকর্তারা। কোথাও নির্দেশনা পর্যন্ত পৌঁছাছে না।

এই অবস্থায় গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বন্যায় শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে করণীয় ঠিক করতে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে ক্ষতি পোষাতে একটি সুনিদিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর এলিয়াস হোসেন মানবজমিনকে বলেন, দুই দফা বন্যার কারণে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেটি পোষানো ছাড়াও আসন্ন পাবলিক পরীক্ষায় বন্যায় কি ধরনের প্রভাব পড়বে তা নির্ণয়ে কাজ করছি। মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষতির পোষানোর সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বৈঠকে।

দেশের জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওড়ে বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই গত জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ফের বন্যা দেখা দেয় সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলায়। ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর সারা দেশের বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু হলেও বন্যার কারণে সিলেট ও মৌলভীবাজারের বেশির ভাগ বিদ্যালয় তখনো বন্ধ ছিল। জুলাইয়ের বন্যার পানি এখনো পুরোটা নামেনি। এর মধ্যেই ১০ই আগস্ট থেকে ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে দেশের ২০টি জেলায় আবারো বন্যা দেখা দিয়েছে। পানি ঢুকে পড়ায় ও সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলমান ষান্মাসিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এবারের বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা লালমনিরহাট। এই জেলার ২৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঠদান বন্ধ করে দেয়া বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে লালমনিরহাট সদর উপজেলায় রয়েছে ৯৫টি, আদিতমারীতে সাতটি, কালীগঞ্জে ২০টি, হাতীবান্ধায় ২২টি ও পাটগ্রামে ১০৭টি। এছাড়া জেলায় ১৫টি কলেজ, ১০টি মাদরাসা এবং ২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও পানি উঠেছে। এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রয়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার জানিয়েছেন, লালমনিরহাটে ২৪৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যার পানি উঠায় ও স্থানীয় বন্যাকবলিত লোকজন আশ্রয় নেয়ায় সাময়িকভাবে এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া হবে। বন্যায় শিক্ষার ক্ষতি পোষানোর জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি। গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে এসব উপজেলার ২৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২২৬টি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম রিয়াজউদ্দিন বলেন, জেলায় বিভিন্ন উপজেলার বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় ২২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিরও আরো অবনতি হওয়ায় পানি ঢুকছে মানুষের বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। এরই মধ্যে জেলার ইসলামপুর উপজেলার ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সিলেটের মৌলভীবাজারের সব পয়েন্টে নদী ও হাওড়ের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি ঢুকে পড়ায় বড়লেখা উপজেলার ৪৬টি, কুলাউড়া উপজেলার ৪০টি, জুড়ী উপজেলার ১৫টি, রাজনগর উপজেলার ১৪টি ও মৌলভীবাজার সদরের চারটি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সব ক’টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলমান পরীক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় উপ-পরিচালক তাহমিনা খানম বলেন, বন্যার কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা কাটিয়ে উঠতে আমরা বিকল্প চিন্তা করছি। বিদ্যালয়ে পানি উঠে যাওয়ায় অনেক স্থানে এখন আশপাশের বাড়িতে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। পানি নামলে প্রয়োজনে বাড়তি সময় ক্লাস নিয়েও যাতে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।
এই অবস্থায় বন্যা চলাকালে সময় ও পরবর্তীতে শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। এরমধ্যে আছে, বন্যা চলাকালীন সময় বিকল্প পদ্ধতিতে ক্লাস পরীক্ষা নেয়া। তবে এটা স্থানীয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিবে। পরীক্ষাগুলো বিশেষ ব্যবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নেয়া যায় কী না তা বিবেচনা রাখার পরামর্শ দিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। অন্যদিকে বন্যা পরবর্তীতে ক্লাস পরীক্ষার ক্ষতি পোষাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস পরীক্ষা নেয়া, বার্ষিক ছুটি বাতিল করা, ক্লাসের সময় বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে যতদূর সম্ভব সিলেবাস শেষ করা, শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক বাড়িয়ে দেয়া, অভিভাবকদের সঙ্গে অতিরিক্ত মতবিনিয়ম করা, শিক্ষার্থীদের নিজ উদ্যোগে ওয়ার্কশিট ও হ্যান্ডআউট সংগ্রহ করতে শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে। এবং এসব উদ্যোগ ফলোআপ করার জন্য শিক্ষকদের বলা হয়েছে।

মাউশির রংপুর অঞ্চলের পরিচালক ড. একেএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, রংপুর অঞ্চলের ৬৪২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাউশির রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান বলেন, নওগাঁ জেলার কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া অন্য কোথাও এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়নি। তিনি আরো বলেন, মাউশির ডিজি বন্যাকবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছি। তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পরবর্তীতে বাড়তি ক্লাস নেয়া হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=79244