৪ মে ২০২৪, শনিবার, ৬:০৯

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

দীর্ঘ তাপপ্রবাহ ও লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদখাত। গত বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি হলেও গরমের তীব্রতা এখনো রয়ে গেছে। তীব্র গরমে বিভিন্ন খামারে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মুরগি। গত ১ সপ্তাহে কমপক্ষে ৭ লাখ মুরগি মারা গেছে। মৎস্য খামারে মাছ মরে ভেসে উঠছে। গরুর খামারে অনেক গুরু অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গরমে গরুর ওলান শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে ২৫ শতাংশ দুগ্ধ উৎপাদান হ্রাস পেয়েছে। গরমে মুরগির খামারে ডিম উৎপাদন অনেক কমে গেছে। সব মিলিয়ে এ খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অনেক ছোট ছোট খামারি ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে আবার নতুন করে লোকসানে পড়ে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন। অন্যদিকে বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দাম বাড়ছে মুরগি ও ডিমের। পাশাপাশি গরুর গোশতের দামও বেড়েছে। সব মিলিয়ে মূল্যবৃদ্ধির চাপে ভোক্তাদের আবার নাভিশ্বাস অবস্থা।
মৎস্য ও পশু খামার নিয়ে খামারিরা যখন দিশেহারা তখন এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নিরব। তীব্র গরম থেকে মৎস্য ও পশু খামার রক্ষায় তাদের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেই। খামারিরা এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য ও পশু কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তারা খামারিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন। মুরগি ও পশু খামারে পর্যাপ্ত ফ্যানের (পাখা) সাহায্যে বাতাস দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। মাছের খামারে সেচের মাধ্যমে পানি দেওয়া কথা বলছেন। কিন্তু যেখানে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎই থাকে না সেখানে ফ্যানের বাতাস দেবে কিভাবে। আর বিদ্যুৎ ছাড়া পানির পাম্পই বা চলবে কেমন করে।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্র্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার ইনকিলাবকে বলেন, চলমান তাপপ্রবাহে ইতোমধ্যে গত ১ সপ্তাহে হিটস্ট্রোকে কমপক্ষে ৭ লাখ মুরগি মারা গেছে। প্রতিদিন ১ লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে। যার ৮০ শতাংশ ব্রয়লার, ১০-১৫ শতাংশ লেয়ার ও সোনালি এবং বাকি ৫ শতাংশ দেশী মুরগি। তার মতে, হিটস্ট্রোকে সব থেকে বেশি মুরগির মৃত্যুর হার নরসিংদীতে। এ অঞ্চলে গত ১২ দিনে প্রায় তিন লাখ মুরগি মারা গিয়েছে। এর পর ময়মনসিংহে, গাজীপুর অঞ্চলে ২ লাখ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১ লাখ ৭৫ হাজার, সিলেট অঞ্চলে ৫০ হাজার, যশোর ১ লাখ ৫০ হাজার, পাবনায় ৫০ হাজার, চুয়াডাঙ্গায় ১ লাখ মুরগি মারা গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে দেশের মুরগি ও ডিমের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ভয়ানক পরিস্থিতিতে ডিম ও মুরগি উৎপাদন কমেছে ৪ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত।

তিনি বলেন, এ ব্যাপরে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোন উদ্যোগ নেই। তারা পানি দেওয়ার, খাবার দেওয়ার, বাতাস দেওয়ার পরামর্শ দিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় তো পানিরও বড় সঙ্কট। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের চলছে ভয়াবহ লোডশেডিং। দিনে তিন চার ঘন্টাও বিদ্যু থাকেনা। এ অবস্থায় ওই সব এলাকায় পোল্ট্রি খামারে মুরগি রক্ষা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, দেশে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার খামার ছিল। কিন্তু লোকসান গুনতে গুনতে ক্ষুদ্র খামারিরা পথে বসেছেন। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর এই ক্ষুদ্র খামারিদের স্বার্থ দেখে না। তারা শুধু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখেন। ক্ষুদ্র খামারিদের ভালোমন্দ দেখলে বর্তমান খামার সংখ্যা ৬ লাখে পৌঁছতো। কিন্তু, সেটা এখন কমতে কমতে ৬০ হাজারে নেমেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, হিটস্ট্রোকে এখন পর্যন্ত ১৫টি গরু মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, মারা যাওয়ার চাইতে এই গরমে গরুর প্রচুর গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে। প্রচ- তাপপ্রবাহে গরুর ওলান শুকিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ দুধের উৎপাদন কমে গেছে। দিনে তিন চার বার গোসল করিয়ে গরু সুস্থ রাখা যাচ্ছে না। ক্ষুরা রোগসহ বিভিন্ন রোগ দেখা যাচ্ছে।

তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন সারাদেশে বয়ে চলা এই তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে মৎস্য ও পশু খামার রক্ষার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. এস এম জোবায়দুল কবির বলেন, তাপপ্রবাহে গবাদি পশুর সুস্থতা রক্ষার্থে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খামারিদের নানা পরামর্শ দেওয়া ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা খামারিদের নানান পরামর্শ দিচ্ছেন। খামারিদের সহায়তায় মোবাইল ভেটেরিনারি টিম কাজ করছে। এ ছাড়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদারকির জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখানে ক্ষয় ক্ষতির হিসাব রাখা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা এ্যানিম্যাল প্রডাকশন অফিসার আলী রেজা বলেন, গত কয়েক দিন ধরে আমরা হিসাব রাখছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার মুরগি মারা যাওয়ার তথ্য আছে। এর মধ্যে ব্রয়লার ও লেয়ারের সংখ্যাই বেশি। তবে, কোনো গরু বা অন্য কোনো গবাদিপশু মারা যাওয়ার তথ্য আমাদের কাছে নেই।

সাভার থেকে আমাদের সংবাদদাতা সেলিম আহমেদ জানান, চরম বির্যয়ের মুখে পড়েছে সাভারের পোল্ট্রি শিল্প। উৎপাদন খরচের সাথে বাজার মূল্যের সমন্বয় না থাকায় ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এলাকার বেশীরভাগ খামার। তবে যে কয়টি খামার এখনও টিকে আছে অতিরিক্ত গরমের কারনে সেসব খামারে মুরগি মারা যাওয়ায় এক অজানা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে খামার মালিকরা। তবে অতিরিক্ত গরমে মুরগি মারা যাওয়ার কোনো তথ্য প্রাণী সম্পদ অফিসে নেই। এমনকি খামারীদের আপডেট কোনো তালিকাও তাদের কাছে নেই।
সাভারের দেওগাঁ এলাকার আর এস পোল্ট্রির মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার খামারে ১২ হাজার লেয়ার মুরগি ছিল। কিন্তু প্রচ- গরমের কারণে দৈনিক ১০টা ২০টা করে মুরগি মারা যাচ্ছে। খামারে ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে তবুও অতিরিক্ত গরমে মুরগি খাবার খেতে পারছে না। খাবার না খাওয়ার ফলে মুরগি দুর্বল হয়ে মারা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আগে ৯০ ভাগ মুরগি ডিম দিত। এখন গরমের কারণে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ডিম পাচ্ছি।

সাভারের কান্দি ভাকুর্তা এলাকায় অবস্থিত হাসমত পোল্ট্রি। খামারটিতে প্রায় ১০ হাজার লেয়ার মুরগি রয়েছে। অতিরিক্ত গরমের কারনে দৈনিক কম বেশি মুরগি এই খামারেও মারা যাচ্ছে। খামারটির মালিক হাসমত উল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, ৬ থেকে ৭ বছর ধরে পোল্ট্রির ব্যবসা করে আসছি। নানান প্রতিকূলতা পেরিয়ে এপর্যন্ত এসেছি। অনেকে খামার ছেড়ে অন্য ব্যবসা করছে, কিন্তু আমি কষ্ট হলেও পোল্ট্রি ব্যবসা ধরে রেখেছি। কিন্তু এই গরমে যেভাবে মুরগি মারা যাচ্ছে তাতে হয়তো খামারটি আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। এভাবে হয়তো একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে এই পোল্ট্রি শিল্প। খাগুড়িয়া এলাকায় মায়ের দোয়া পোল্ট্রি ফার্মে প্রায় ১৫ হাজার মুরগি রয়েছে। প্রচ- গরমে এই ফার্মেও কমবেশি মুরগি মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ফার্মের মালিক মালু মিয়া। সাভার উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সাজেদুল ইসলাম সাভারে পোল্ট্রি শিল্পের বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে বলেন, একসময় সাভারে প্রায় আড়াই হাজার খামার ছিল। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু’র কারনে পোল্ট্রি শিল্পে যে বিপর্যয় শুরু হয়েছ তা এখনও থেমে নেই।
তীব্র গরমে সাভারের মত সারা দেশে পোল্ট্রি শিল্পে অবস্থা নাজুক। এ ছাড়া মৎস্য এবং পশু খামারেরও একই অবস্থা। তীব্র গরমে মাছ মরে ভেসে উঠছে। গরু অসুস্থ হয়ে পড়ছে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে এবং পটুয়াখালির গলা চিপায় বিভিন্ন খামারে তীব্র গরমে মাছ মরে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা তার কাছাকাছি থাকলে ৮০ শতাংশ মৎস্য রেণু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত রেণু ও পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। তা ছাড়া এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মাছ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। এই সময়টায় মাছের চাষ স্বাভাবিক না থাকলে মোটা দাগে মাছ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গোয়ালন্দের অনেক মৎস্যচাষি এ সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মৎস্য হ্যাচারি থেকে মাছের ডিম কিনে এনে রেণু পোনা তৈরি করে ব্যবসা করে থাকেন। বর্তমান পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেকের পুকুরের পানি অত্যধিক গরম হয়ে ডিম রেণু নষ্ট হয়ে গেছে। বেশির ভাগ পুকুরে পানি না থাকায় ডিম ও পোনা ছাড়তে পারছে না। ফলে তাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গলাচিপা উপজেলা তাপদাহের জন্য পুকুরের মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এতে চরম ক্ষতির মুখে রয়েছেন শত শত চাষি। খাল নদী থেকে পুকুরে পানি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তাপপ্রবাহের কারণে গত সাতদিনে গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের উত্তর আনালেরতারি গ্রামে প্রতাপ ঘোষের চারটি বিদেশী জাতের গরু মারা গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে খামারের বাকি গরুগুলোও। খামারে একাধিক ফ্যান লাগিয়ে, এমনকি চালে পানি ছিটিয়ে পশুর ঘর ঠা-া রাখার চেষ্টা করলেও তাতে কাজ হয়নি। একই কথা জনিয়েছেন গাইবান্ধা সদরের উত্তর গিদারী গাছের ভিটা গ্রামের খামারি জোহা মিয়া। তিনি জানান, গত চারদিনে হিট স্ট্রোকে তার ছয়টি গরু মারা গেছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/655395