২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১১:০৫

সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না

২৮ বছরে নিহত ১ হাজার ৪১৩ জন বাংলাদেশী

সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও থামছে না ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনা। পতাকা বৈঠকেই সীমাবদ্ধ সমাধানের পথ। পৃথিবীর কোনো দেশের সীমান্তে এত হত্যাকা- হয়েছে এমন নিজর নেই। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ১৫ জনকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সরকারের হিসেবে বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৯ বছরে বিএসএফের হাতে ২৯১ জন বাংলাদেশী নিহত হন। এ ৯ বছরের মধ্যে সবচে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন ২০০৯ সালে। আর সবচেয়ে কম ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন ২০১৭ সালে। আর বেসরকারি আরেকটি হিসেবে তথ্য পাওয়া গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ বছরে বিএসএফ এর গুলীতে ১ হাজার ৪১৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে।

জানা গেছে, চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার পিলখানায় ‘বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। আর ৯ মার্চ সকালে যৌথ আলোচনার পর দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয়। মূলত ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে অংশ নেয়া শেষে বিএসএফ প্রধানের ফিরে যাওয়ার পর তাদের মারমুখী অবস্থান বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলী ও নির্যাতনে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ বাংলাদেশীরা। বিগত ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএসএফের গুলীতে নির্মম হত্যার শিকার হয় কিশোরী ফেলানী খাতুন। তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে রাখা হয়েছিল। ওই সময় কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর লাশের ছবি আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে। ওই ঘটনার পর দফায় দফায় আলোচনায় সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ। তবে গত ১২বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় একেবারেই উল্টোচিত্র।
প্রায় প্রতিমাসেই বিএসএফের হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। পাশাপাশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছেন ১৫ জনের বেশি। গতকাল শুক্রবারও লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে আবুল কালাম নামের এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়। ভোরে পাটগ্রাম সীমান্তের ৮৪৮ নাম্বার পিলারে ৯ নম্বর সাব পিলার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গত এক মাসে লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফ গুলীতে তিন বাংলাদেশী নিহতের ঘটনা ঘটলো। মার্চ মাসের ৮ দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট ও নওগাঁ সীমান্তে প্রাণ গেছে অন্তত ৪ জনের। ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে অংশ নেয়া শেষে বিএসএফ প্রধানের ফিরে যাওয়ার পর তাদের মারমুখী অবস্থান দেখা গেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে মারা গেছেন ২০০ এর বেশি বাংলাদেশী। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে গতবছর ২৮ জনের প্রাণহানি ও ৩১ জন মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আসকের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশীকে হত্যা করে বিএসএফ। ওই বছর ৪৮ জন বাংলাদেশী প্রাণ হারান, যার মধ্যে ৪২ জন বিএসৎএফের গুলীতে ও ছয়জন শারীরিক নির্যাতনে মারা যান। এর আগের বছর যে ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ৩৭ জন বিএসএফের গুলীতে এবং ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনে। গত সাত বছরের মধ্যে বিএসএফের গুলীতে সবচেয়ে কম বাংলাদেশীর মৃত্যু হয় ২০১৮ সালে ১৪ জনের। সরকারি হিসাব অনুসারে ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ জন। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যাকা- নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের পক্ষ বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের আশ্বাসও দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

সীমান্ত হত্যার দীর্ঘ মিছিল: পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২২ সালে ২৩ জন এবং ২০২১ সালে ২৪ জন। ২০২০ সালে ৪৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের পুরো সময়টায় ভারতের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বা বিএসএফ এর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৩ জন বাংলাদেশী - যাদের মধ্যে ৩৭ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন গুলীতে, আর বাকি ৬ জনকে নির্যাতন করে মারা হয়। ২০১৮ সালে ১৪ জন। ২০১৭ সালে ২৫ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন, ২০১৪ সালে ৪০ জন, ২০১৩ সালে ২৮ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১১ সালে ৩৯ জন, ২০১০ সালে ৬০ জন, ২০০৯ সালে ৬৭ জন। এদিকে ২০০৭ ও ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দুই বছরে নিহত হয় ১৮২ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ৬২ জন এবং ২০০৭ সালে ১২০ জন নিহত হয়। অর্থাৎ ওই আমলে প্রতি বছরে গড়ে প্রাণ হারিয়েছে ৯১ জন করে। ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৪ সালে ৭১ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন, আর এই হিসাব ২০০০ সাল থেকে ধরলে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০২০ এই ২০ বছরে ১ হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে খুন হয়েছেন। ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা অনেক বেশি।

সীমান্তে হত্যা বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। সেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করতে একমত হয় দুই দেশ। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি সীমান্তে। সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য মতে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুদশকে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ১ হাজার ১৮৫ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে।

পাটগ্রামে বিএসএফের গুলীতে বাংলাদেশী নিহত: লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে আবুল কালাম (২৪) নামের এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ভোরে পাটগ্রাম সীমান্তের ৮৪৮ নাম্বার পিলারে ৯ নম্বর সাব পিলার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গত এক মাসে লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফ গুলীতে তিন বাংলাদেশী নিহতের ঘটনা ঘটলো। নিহত আবুল কালাম পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ঝলঙ্গি পকেট এলাকার অপির উদ্দিনের ছেলে। জানা গেছে, পাটগ্রাম সীমান্তের ৮৪৮ নাম্বার মেইন পিলারের ৯ নম্বর সাবপিলার এলাকা দিয়ে ভারতীয় সীমানার ঝলঙ্গি পকেট পাড়ায় চোরাচালানের উদ্দেশ্য যায় একদল বাংলাদেশী।

এসময় ভারতীয় সীমানায় দায়িত্বরত ১৬৯ ডুরাডাবড়ী বিএসএফ ক্যাম্পের দহল দল তাদের লক্ষ্য করে গুলী ছুড়ে। এতে আবুল কালাম নামের একজন গুরুতর আহত হয়। পরে সহযোগীরা চিকিৎসার জন্য পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেয়ার পথে তিনি মারা যান। এর আগে গত ২২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলীতে হাসান (২৬) নামে বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের পুটিয়া সীমান্ত এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত হাসান ওই এলাকার দারু মিয়ার ছেলে। নিহত হাসানের চাচাতো ভাই আরিফ জানান, হাসান বিভিন্ন সময় সীমান্তের ওইপার থেকে চিনি চোরাচালানে শ্রমিকের কাজ করতেন। সকালে সীমান্ত থেকে চিনি আনতে গেলে বিএসএফ গুলী চালায়। পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

https://www.dailysangram.info/post/554640