১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১২:০৩

খুলনায় নলকূপ পাম্পে পানি নেই, হাহাকার

খুলনা নগরীর শেখপাড়া এলাকায় সিরাজুল ইসলামের চারতলা ভবন। সেখানে রয়েছে নলকূপ ও মোটর দিয়ে পানি তোলার ব্যবস্থা। কিন্তু এ মাসের প্রথম থেকে নলকূপ ও মোটর কোনোটিতেই পানি উঠছে না। ওয়াসার পাইপলাইনের পানি দিয়ে অন্য প্রয়োজন মিটছে। খাবার ও রান্নার পানির জন্য তাঁকে ছুটতে হচ্ছে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। সিরাজুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘পানির এই কষ্ট কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। নিজের বাড়িতে কল থাকতেও খাবার পানির জন্য পাশের বাড়ি যাচ্ছি। দিনে সবার সামনে পানি টানতে লজ্জা লাগে, তাই রাতে আনি।’

নগরীর মৌলভীপাড়া টিবি বাউন্ডারি রোডে মডার্ন টাওয়ারের সামনে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে পানি নিতে যান অন্তত ৫০-৬০ জন। ওই ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী মো. বাবুল জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টা এবং বিকেল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে লোকজনকে বিনামূল্যে পানি দেওয়া হয়। আশপাশের অনেক বাড়ির নলকূপ ও পাম্পে পানি না ওঠায় তারা এখান থেকে পানি নিয়ে যান।

চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে খুলনা নগরীর বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষকে খাবার পানির জন্য এমন অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হচ্ছে। এ মাসের প্রথম দিক থেকে শেখপাড়া, গোবরচাকা, বড় মির্জাপুর, ছোট মির্জাপুর, বাইতিপাড়া, টুটপাড়াসহ আরও অনেক এলাকার বাড়ির অগভীর নলকূপ থেকে একেবারেই পানি উঠছে না। আগে সড়কের পাশে ছোট মির্জাপুর এলাকায় দুটি, বড় মির্জাপুর এলাকায় দুটি, বাইতিপাড়া এলাকায় দুটি, দেবেন বাবু রোড ও টিবি বাউন্ডারি রোডে একটি নলকূপ ছিল। পানি না ওঠায় সেগুলো খুলে ফেলা হয়েছে। গভীর নলকূপের সঙ্গে যাদের পাম্প রয়েছে, সেগুলোতেও পানি ওঠার পরিমাণ কমে গেছে। ঠিকমতো পানি উঠছে শুধু গভীর নলকূপের সঙ্গে থাকা সাবমার্সিবল পাম্পে। তবে তা স্থাপন ব্যয়বহুল হওয়ায় সবাই বসাতে পারছেন না। খুলনা ওয়াসা পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করলেও তা পানের উপযোগী নয়।

এই সংকটের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীতে দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিতভাবে গভীর-অগভীর নলকূপ, সাধারণ পাম্প ও সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। প্রতিদিন ভূগর্ভ থেকে ৫ কোটি লিটারের বেশি পানি না তুলতে পরামর্শ দিয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। কিন্তু পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্রমাগত নিচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গত ৯ বছরের ব্যবধানে খুলনা নগরীর ১৪টি ওয়ার্ডে পানির স্তর নিচে নেমেছে ১ দশমিক ৯৮ মিটার থেকে ৪ দশমিক ০৪ মিটার (১৩ দশমিক ২৫ ফুট) পর্যন্ত। এ কারণে অনেক নলকূপ ও পাম্পে পানি উঠছে না।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন বাগেরহাটের মোল্লাহাট এলাকার মধুমতী নদীর ১১ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করে খুলনা নগরীতে সরবরাহের জন্য একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল ওয়াসা। ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়া এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু সক্ষমতা বেশি থাকলেও ওয়াসা এখন ওই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরবরাহ করছে প্রায় ৫ কোটি লিটার পানি।

ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, ভূগর্ভ থেকে এখন ৪২টি পাম্পের মাধ্যমে প্রতিদিন ওয়াসা তুলছে ২ কোটি লিটার পানি। আর নগরবাসী বছরের প্রায় ১০ মাস ওয়াসার মালিকানাধীন প্রায় ৯ হাজার ৬০০ নলকূপ দিয়ে ২ কোটি লিটার এবং ব্যক্তিগত ১৪ হাজার নলকূপ ও সাধারণ পাম্প দিয়ে তোলে প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, নগরী ও সংলগ্ন এলাকাগুলোতে জলাশয় এবং বৃষ্টিপাতের সময়সীমা ও পরিমাণ কমে গেছে। এ ছাড়া ভূগর্ভ থেকে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, তার সমপরিমাণ পানি ভূগর্ভস্থ স্তরে জমা হচ্ছে না। এতে পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে এবং প্রতিবছরই পানির সংকট বাড়ছে।

খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ বলেন, ভূগর্ভ থেকে ১ হাজার লিটার পানি তুলে সরবরাহ করতে তাদের ব্যয় হয় ১১ টাকা। আর মধুমতী নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহে ব্যয় হয় সাড়ে ১৭ টাকা। তারা গ্রাহকের কাছ থেকে ১ হাজার লিটার পানির দাম নেন ৯ টাকা। ব্যয় কমাতে ভূগর্ভের পানি তোলা পুরোপুরি বন্ধ করেননি তারা।

এত ব্যক্তিগত নলকূপ ও সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার ৮০০। কিন্তু এখনও প্রায় ২০ শতাংশ পরিবার ওয়াসার পানির সংযোগ গ্রহণ করেনি। তারা নলকূপ ও পাম্প দিয়ে পানি তোলে।

https://samakal.com/whole-country/article/233010