৮ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১০:০৪

ঈদ উদযাপনে সাধারণ মানুষের যত সংকট

-আলী আহমাদ মাবরুর

ইসলাম তার সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব পালনের বিধান প্রবর্তন করেছে। এই উৎসবগুলো আবার বিভিন্ন দেশে এসে স্থানীয় সংস্কৃতির স্পর্শে ভিন্ন ধরনের মাত্রা পেয়েছে। মুসলিমদের জন্য বছরে প্রধানতম উৎসব হলো দুই ঈদের উৎসব। এর মধ্যে ঈদুল আযহায় কুরবানিসহ নানা ধরনের আচারাদির জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখার কারণে সাধারণভাবে মানুষ উৎসব হিসেবে রোজার ঈদ বা ঈদুল ফিতরটাই বেশি উদযাপন করে। রাসূল সা. এর সীরাতে যেমন ঈদের দিন নতুন পোশাক পরিধানের তথ্য পাওয়া যায়, আবার আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতেও ঈদুল ফিতর মানেই নতুন পোশাক পরিধান এবং এর সাথে মিষ্টান্নসহ নানা ধরনের বাহারি আয়োজনের প্রচলন অনেকদিন থেকেই চলে আসছে।

তবে এবারের ঈদ উদযাপনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মানুষ যেন বড্ড বেশি সংকুচিত হয়ে আছে, বুঝে শুনে বের হচ্ছে, হিসেব করে খরচ করছে। বাংলাদেশ যেহেতু জনবহুল দেশ তাই মানুষের আধিক্য থাকে সবখানেই। আপনি মসজিদে যেমন মুসুল্লী দেখবেন, আবার একই সময়ে রাজপথেও বহু মানুষ দেখতে পাবেন আবার মার্কেটে গেলেও মনে হবে বোধহয় শহরের সব মানুষ একসাথে মার্কেটে চলে এসেছে। তবে, অন্তরালের প্রকৃত চিত্র হলো, সমাজের বহু মানুষই হাহাকারে আর পেরেশানিতে দিন কাটাচ্ছে। পরিবারের সদস্যগণ বিশেষ করে কনিষ্ঠ সদস্যবৃন্দ বা বাচ্চাদের ঈদ কেন্দ্রিক একটি আগ্রহ থাকলেও তাতে সায় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না অনেক অভিভাবকের পক্ষেই।

যেকোনো পোশাকের দাম গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এটি যেন অনেকটাই অপরিহার্য হয়ে গিয়েছে যে, সকলেই সকল পণ্যের বিক্রয় মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। অমুক ব্যবসায়ী তমুক ব্যবসায়ীর রেফারেন্স দিয়ে দাম বৃদ্ধি করছেন। একটি পণ্যের বিক্রেতা আবার অন্য কোনো পণ্যের বর্ধিত দামের অজুহাতে তার কাছে থাকা পণ্যের বাড়তি দাম নিচ্ছেন। অর্থাৎ কারণ বা প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন দাম বাড়ছেই। আর তাতে পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। মার্কেটগুলোতে যেমন অনেকেই কেনাকাটা করছেন, আবার এর চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ শুধু পণ্যগুলো দেখেই বাসায় ফেরত চলে আসছেন। গত বছরের তুলনায় এ বছরের জামা কাপড়ের দাম অনেকটা বৃদ্ধি হওয়ায় কেনাকাটায় হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ নিম্ন ও মধ্য আয়ের ক্রেতাদের। মিলছে না প্রিয়জনদের পছন্দের পোশাক; পছন্দ হলেও দাম থেকে যাচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে। ক্রেতারা আসছেন, ঘুরে দেখছেন, দরদাম করছেন, পছন্দ হলে কিনছেন। তবে বেশিরভাগ ক্রেতার অভিযোগ, গত বছরের চেয়ে এবার সবকিছুর দাম প্রায় দ্বিগুণ।

শপিংমলগুলোর বিক্রেতারাও ঈদের বেচাকেনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষ অস্বস্তিতে পড়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে ঈদ বাজারেও। এ কারণে অন্যবারের তুলনায় বাজার জমতে একটু বেশি সময় লাগছে। একজন পোশাক বিক্রেতার সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, “অন্য বছরগুলোতে রমযান মাস আসলেই যেখানে ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে যায় সেখানে এবার ১৫ রমযান পার হওয়ার পরও তারা আশানুরূপ ক্রেতার দেখা পাননি। বিক্রেতারা আরো দাবি করছেন, ‘এবারের বছরে পোশাকের দাম একটু বেশি কারণ আমাদেরও বেশি টাকা দিয়েই কিনতে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দাম দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আরো বলছেন, প্রতিবছরই দাম বাড়ছে কাপড়, রঙ, সুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের পোশাক তৈরির কাঁচামালের। একই সঙ্গে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়েছে ঈদে পোশাকের দামে। তাদের মতে, পোশাক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়ের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। পরিবহন খরচ ও শ্রমিকের মজুরিসহ আরো ২০ শতাংশ বাড়তি খরচ বৃদ্ধিরও দাবি করেন তারা।

অন্যদিকে, ক্রেতাদের অভিযোগ হলো, বাচ্চাদের জন্য ঈদের পোশাক কিনতেই তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের আফগান পোশাক কিনতে হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ করে। ঈদের জন্য তারা যে বাজেট নির্ধারণ করেছিলেন তা দিয়ে কোনোভাবেই ঈদের কেনাকাটা করা যাচ্ছে না। একাধিক সন্তানের বাবা-মা বাধ্য হয়ে কেবল একটি সন্তানের পোশাক কিনছেন আর অন্যদের বঞ্চিত করছেন। শুধু রফতানিকৃত পোশাকই নয়, বরং কোনো ধরনের যৌক্তিক কারণ ছাড়াই দেশীয় পোশাকগুলোর দামও অবিশ^াস্যরকম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদেরকে নিজেদের মতো করে রেশনিং করতে হচ্ছে। তারা বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কোনটা বেশি জরুরি তা নির্ধারণ করেই বের হচ্ছেন। অনেকেই ঈদের দিনের খাবার তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং নতুন পোশাক কেনার চিন্তা থেকে সরে এসেছেন। কোনো কোনো ক্রেতা এমনও দাবি করছেন যে, তারা শুধু ঈদের বাজেটই নয়, বরং ঈদের যে বোনাস পেয়েছেন কিংবা বাকি মাস চলার জন্য যে টাকা আলাদা করে রেখেছিলেন সবটুকু দিয়েও পরিবারের সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা করতে পারছেন না।

এদিকে উচ্চবিত্তরা নগরীর নামিদামি শপিংমল থেকে কেনাকাটা করলেও স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা ছিল রাস্তার পাশের ফুটপাতের বাজারগুলো। কিন্তু এবার এক্ষেত্রে একটি রহস্যজনক বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। ১৫ রমযানের পর থেকে অনেক এলাকায় এবং রাস্তার পাশে থাকা ভ্যান ও ফুটপাতে স্থাপিত দোকানগুলোকে তুলে দেয়া হয়েছে। যেসব জায়গায় আগে আগে সারি সারি ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতো এবং যেখান থেকে স্বল্প আয়ের মানুষেরা কেনাকাটা করতো- এবার সেই জায়গাগুলোতে কোনো ভ্যান নেই। আমি নিজে একদিন উত্তরা থেকে বাড্ডা হয়ে রামপুরা পর্যন্ত বাসে যাওয়ার সময় ফুটপাত ও ভ্যানের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কম দেখেছি। রাস্তা দখল ও জ্যাম তৈরির অজুহাতে এদেরকে তুলে দেয়া হলেও কার্যত এর মাধ্যমে সমাজের বড়ো সংখ্যক মানুষের ঈদ উদযাপনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, ফুটপাত ও হকারমুক্ত রাস্তাঘাট করার নেপথ্যে শপিং মল মালিকদের স্বার্থ থাকতে পারে। নি¤œবিত্ত মানুষগুলোকে মার্কেটে যেতে বাধ্য করার জন্যই হকার তুলে দেয়া হয়েছে বলেও তারা মনে করেন। আমি এর সত্যতা জানি না। তবে এটুকু জানি, মার্কেটে গিয়ে চড়া দামে পোশাক কেনার মতো সক্ষমতা এই স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর নেই।

আমাদের দেশের নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে অবস্থাসম্পন্ন মানুষের একটি সাধারণ স্বভাব হলো তারা নিজের মতো করে সবার অবস্থাকে মূল্যায়ন করেন। তারা যেহেতু আর্থিকভাবে সচ্ছল, এবং তারা যেহেতু যাবতীয় কেনাকাটা করতে পারছেন, তাই তারা ধরেই নিয়েছেন যে, সমাজের সব মানুষেরই ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং সবাই বোধহয় স্বস্তির সাথেই ঈদ শপিং করতে পারছেন। তবে এই চিত্র মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। শহরের বাসাবাড়িতে কান পাতলে বাচ্চাদের কান্না আর অভিভাবকদের ব্যর্থতার গ্লানিমাখা হাহাকার শোনা যায়। মানুষের সহযোগিতা ও দান-সদাকায় অনেকের রোজার মাস অতিবাহিত হলেও আসন্ন ঈদ নিয়ে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। সন্তানদের সামনে তারা কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবেন সেই অজানা কষ্টে তারা চোখের পানি ফেলছেন।
সেদিন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদে একটি প্রতিবেদন দেখলাম। কারওয়ান বাজারের এক ফুটপাত ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলেছেন জনৈক সাংবাদিক। ঐ হকার অবলীলায় স্বীকার করে নিলেন যে, সারাদিনে তিনি দু একটির বেশি পোশাক বিক্রি করতে পারেননি। সাংবাদিক যখন তাকে প্রশ্ন করলেন, এত কম বিক্রি হলে কীভাবে তিনি ঈদ করবেন, সন্তানদের চাওয়াগুলো পূরণ করবেন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট হকার কেঁদে ফেললেন। টেলিভিশন ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে জানার পরও তিনি তার চোখের পানি আঁটকাতে পারেননি। বাস্তবতা হলো, এই হকারের চোখের পানি হয়তো আমরা দেখেছি, কিন্তু আমাদেরই চারপাশে অনেকেই দিব্যি এভাবেই চোখের পানি ফেলছেন, কিন্তু আমরা তা অনুধাবন করতে পারছি না।

শুধু ঈদের পোশাক নিয়েই সংকট নয়। বছরের এই একটি দিনে ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্ত সকলেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। বিশেষ করে পরিবারের ছোট সদস্যরা একটু পোলাও, অন্যান্য রিচ ফুড, মিষ্টান্ন ও বাহারি পদের গোশত খাওয়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু এবার রোজা আসার এক মাস আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য মানুষের একদম হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। শুধু ঈদের দিনের খাবারের আইটেমই নয়, বরং প্রতিদিনের জন্য নিয়মিত যে খাবার খেতে হয়, সেই উপকরণগুলোর দামও বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে।

এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দরিদ্র থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও নিজেদের চাহিদা পূরণে অক্ষমতা প্রকাশ করছে। প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র খুললেই চোখের সামনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সংবাদ দৃষ্টিগোচর হয়। অনেকেই মনে করেন, সত্যিকারের বাজার তদারকি না হওয়ায় সেই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করার স্বার্থে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করছে। আর বাংলাদেশের নির্মম বাস্তবতা হলো, দ্রব্যমূল্য একবার বেড়ে গেলে তা আর নিয়ন্ত্রণে আসে না, এমনকি সরকারও আর দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

আগে রাস্তাঘাটে যখন টিসিবির ট্রাক দেখতাম সেখানে শুধু হাতেগোনা মানুষকেই দেখা যেতো। তাছাড়া যারা সেখানে যেতেন তারাও ছিলেন একদমই দরিদ্র শ্রেণীর। অথচ টিসিবি ট্রাকের পণ্যের জন্য এই লাইন এখন অনেকটা দূর চলে যায়। মানুষজন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকেন কাক্সিক্ষত পণ্যের জন্য। মর্মান্তিক সত্য হলো, যারা এখন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন সবাই যে নিম্নবিত্তের তাও কিন্তু নয়। মধ্যবিত্তও এখন লাজ শরম ছুড়ে ফেলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য নিজের মান সম্মানের তোয়াক্কা না করে এই মানুষগুলো এখন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিসিবির পণ্য কেনেন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। তার মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বাজারে পণ্যের দাম লাগামহীন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এবং সরকারের দুর্বল নজরদারি। লোক দেখানো কিছু ইনসপেকশন ছাড়া প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো তৎপরতাই এখনো চোখে পড়েনি। ফলশ্রুতিতে, চাল, ডাল, তেল, ডিম, আটা থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে গাড়ি ভাড়া।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, গাড়ির ভাড়া যখন বাড়ে তখন বাড়ে টাকার হিসেবে। আর যখন কমে তখন কমে পয়সার হিসেবে। অতি সম্প্রতি বিভিন্ন রুটে বাসের ভাড়া ৩ পয়সা কমার একটি খবরও গোচরে আসলো- যা জনগণের সাথে পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে, জরুরি পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সীমিত আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। কারণ দ্রব্যমূল্য বাড়লেও বাড়েনি তাদের আয়। ফলে অনেকেই ব্যয় কাটছাঁট করছেন। অনেকে ভাঙছেন সঞ্চয়। নয়তো গয়না বিক্রি করছেন সংসার চালানোর জন্য। সারা বছরই জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়তেই থাকে আর রোজা বা ঈদের সময়ে আরেক দফা বাড়ানো হয়। ফলে জনজীবনে হচ্ছে দুঃখ ও ভোগান্তির শিকার। ধানের ভরা মৌসুমেও দাম বাড়ছে চালের। শুধু চাল নয়, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ ও চিনিসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই এখন বাড়তির দিকে। জিরার গুড়ার দাম মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৪শ’ টাকার ওপর বেড়েছে। একইভাবে অন্যান্য মসলা এবং বিভিন্ন ধরনের শখের খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর দামও বেড়েছে আশংকাজনকভাবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তসহ স্বল্প আয়ের মানুষের যেখানে নাভিশ^াস উঠছে; ঠিক তখনই বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের মতো সেবা সার্ভিসের মূল্য দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় দেশের ক্রেতা-ভোক্তা সাধারণ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে। গাড়িভাড়ার মতো জ¦ালানি তেলের দাম নিয়েও পরিহাস চলছে। যখন দাম বাড়ানো হয়েছিল তখন লিটার প্রতি ৪০-৪৫ টাকা একবারে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। আর যখন কমানো হলো তখন লিটারে হ্রাস হলো মাত্র তিন টাকা, আর ডিজেলে কমেছে মাত্র ৭৫ পয়সা। প্রকৃতপক্ষে, সরকারের ভর্তুকী দেয়ার সক্ষমতাও এখন কমে এসেছে। আর তাই বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার লোভে সরকার দাতাগোষ্ঠীর দেয়া শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে আর সেই শর্তের অংশ হিসেবেই জ¦ালানি উপকরণের দাম এ্যাডজাস্ট করার নামে বারবার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রতিমাসেই নিয়মিতভাবে দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে রান্না করার মূল উপকরণ তথা সিলিন্ডার গ্যাসের।

কার্যত, টাকার দাম কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। একসময় ১শ’ টাকা বা ৫শ’ টাকারও দাম ছিল। কিন্তু এখন এক হাজার টাকা নিয়ে বের হলেও বাজারে গিয়ে অর্ধেক বাজার করার আগেই বরাদ্দ টাকা ফুরিয়ে যায়। এই অবস্থায় যে ঈদুল ফিতর আসছে, তাতে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো আনন্দ আয়োজনে সক্ষম হলেও সমাজের অনগ্রসর মানুষ যে তাতে অংশ নিতে পারবে না তা অনেকটাই নিশ্চিত। নি¤œআয়ের মানুষগুলো অত্যন্ত সহজাতভাবেই বলছেন, ‘গরিবের আবার ঈদ আছে নাকি, ঈদ তো বড়োলোকদের আনন্দ আয়োজন।’ এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক বাস্তবতা যে, আমরা আমাদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসবটাও সমাজের একটি বড়ো অংশকে সাথে নিয়ে উদযাপন করতে পারছি না। বরং এই ঈদ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই মানুষগুলোর জীবনে অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা সংকট তৈরি করে ফেলছে। অনাচার আর সুশাসনের কমতির এই সময়ে বিদ্যমান বিষন্ন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা চোখে পড়ছে না। ফলে, ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ- এ সুন্দর পংক্তিমালা এবার হয়তো শুধু মুখের বুলিতেই থেকে যাবে।

https://www.dailysangram.info/post/553429