৭ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ৩:১৯

লোডশেডিংয়ে টিকতে পারছেন না পর্যটকরা

বিদ্যুতের উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদন হয় কক্সবাজারে। এই জেলার দুটি কেন্দ্র থেকে দৈনিক সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট শক্তি যোগ হয় জাতীয় গ্রিডে। এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাতি জ্বললেও অধিকাংশ সময় অন্ধকারে থাকে পর্যটন নগরীটি। গড়ে প্রতিদিন ছয় ঘণ্টার মতো লোডশেডিং হয় শহর এলাকায়। আর গ্রামের পরিস্থিতি আরও শোচনীয়, বিদ্যুৎ থাকে না সাত ঘণ্টার ওপরে। তীব্র গরমে হোটেল-মোটেলে টিকতে পারছেন না পর্যটকরা। ঈদ ঘিরে ভ্রমণপিপাসুদের ঢল নামার কথা থাকলেও আশঙ্কাজনক হারে কমছে বুকিং। ধস নেমেছে বহু কলকারখানায়। বেড়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রস্তুত করা পণ্যগুলোর উৎপাদন খরচ। যার প্রভাব পড়বে সারাদেশের ভোক্তার ওপর।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দৈনিক ৪০০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার খুরুশকুলে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যোগ হচ্ছে আরও ৫০ মেগাওয়াট করে।

উৎপাদনের শহরে বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের বিলাসি স্বপ্নতো দূরের কথা, খোদ পবিত্র রমজানে ইফতার ও সেহরির সময়ও পাওয়া যায় না সরবরাহ। তারাবি পড়তে গিয়ে শরীর ঘামে ভিজে জবজব। রাতে শান্তির ঘুম না হওয়ায় দিনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কর্মস্থলে। লোডশেডিংয়ের কারণে অলস সময় পার করতে হচ্ছে অনেক ছোট কলকারখানার শ্রমিকদের। বরফ কলে উৎপাদন বন্ধ থাকায় মালিকদের লোকসানের পাশাপাশি ফ্রিজিং করতে না পারায় পচে যাচ্ছে লাখ লাখ টাকার মাছ। তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ায় সপ্তাহখানেক ধরে চলছে এই দুর্বিষহ অবস্থা।

কক্সবাজার শহরের বৈইল্লা পাড়ার গৃহিণী সুমাইয়া ছিদ্দিকা বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে শীতকালে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। দিন ও
রাতের অধিকাংশ সময় থাকতে হচ্ছে বিদ্যুৎবিহীন। তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎনির্ভর যন্ত্র।

শহরের হাসপাতাল সড়ক এলাকার বাসিন্দা সমাজসেবক মোহাম্মদ আলী বলেন, বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতি নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সাধারণ মানুষ দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করলেও অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে দ্বৈত সংযোগ দেওয়া হচ্ছে বিত্তশালীদের।

চার শতাধিক হোটেল ব্যবসায় ধস
অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে সাগরপাড়ের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস ব্যবসায় ধস নেমেছে। দৈনিক চার মেগাওয়াট বিদ্যুতের পরিবর্তে সরবরাহ করা হচ্ছে দুই মেগাওয়াট। বিদ্যুতের এই আসা-যাওয়ার খেলায় অতিষ্ঠ পর্যটকরা হোটেলে থাকতে পারছেন না। অনেকে বেশি দিন অবস্থানের পরিকল্পনা করেও তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে পর্যটকের আগমনও। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি রাজস্ব হারিয়ে লোকসানে পড়ছে সরকারও।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে ডুবে যায় সৈকতের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস। জেনারেটর চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সামর্থ্য সবার নেই। আবার খরচও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে বিরক্তিকর উচ্চ শব্দ, যা পর্যটকদের রীতিমতো অতিষ্ঠ করে তুলছে।

৫০ বরফকল বন্ধের পথে
কক্সবাজার বরফকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ আবেদীন নান্নু বলেন, সদর উপজেলাসহ জেলায় ৫০টি আইস মিল রয়েছে। এসব কল থেকে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার বরফ তৈরি হয়। কিন্তু সম্প্রতি লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানা অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকছে, অলস সময় পার করছেন শ্রমিকরা। এতে কল শ্রমিক ও মালিকদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মাছ ব্যবসায়ীরা। নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার মাছ। টানা তিন ঘণ্টাও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া হয় না।

৫৪ হ্যাচারি বন্ধের উপক্রম
হ্যাচারি মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নজিবুল ইসলাম জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে জেলার ৫০টি হ্যাচারিতে দৈনিক কমপক্ষে ১৫ হাজার লিটারের বেশি জ্বালানি খরচ হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে দৈনিক ১১ লাখ টাকার বেশি। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে মাছ ব্যবসায়।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গণি সমকালকে বলেন, এই জেলায় দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ৪০ মেগাওয়াট। বর্তমানে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ মেগাওয়াট।

অন্যদিকে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মকবুল আলম বলেন, দৈনিক ১০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে ৫১ মেগাওয়াট। উৎপাদন না বাড়লে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

কক্সবাজার নাগরিক কমিটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও এই জেলার মানুষ থাকেন অন্ধকারে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? পর্যটন নগরী ও হাজার হাজার ক্ষুদ্রশিল্পের কথা বিবেচনায় অবিলম্বে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা উচিত।

https://samakal.com/whole-country/article/231539