৭ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ৩:০০

তাপদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং ॥ চরম দুর্ভোগ মানুষের

প্রচন্ড তাপদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে লোডশেডিং বেড়েছে বেশি। দেশের কোন কোন স্থানে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় কোথাও ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ফলে ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে জনজীবনে। জ্বালানি সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর এতে হচ্ছে লোডশেডিং। এমনটা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

একদিকে রোজার মাস আবার দেশজুড়ে এখন মৃদু তাপপ্রবাহ চলছে। চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। এরই মধ্যে দৈনিক ৮-১০ ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে ঝালকাঠি ও গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারা। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের আগে এই সমস্যার সমাধানে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে।

হঠাৎ করেই প্রকৃতিতে বেড়েছে গরমের অনুভুতি। দুর্বিষহ জনজীবন। এর সাথে দেশের অনেক স্থানেই শুরু হয়েছে লোডশেডিং। গাইবান্ধায় কয়েকদিন ধরে দিন-রাতে বিদ্যুৎ না থাকার উৎপাত চলছে। তার ওপর রমযানে দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। লোডশেডিং এর কারণে ব্যাহত হচ্ছে কলকারখানার কাজ। ঈদের আগে এমন অবস্থায় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন মালিক-শ্রমিকরা। শ্রমিকরা জানান, ২ ঘণ্টা ৩ ঘণ্টা পর পর বিদ্যুৎ আসে এরপর আধাঘণ্টা থেকে আবার চলে যায়। স্থানীয়রা জানান, সারাদিনে আধা ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। রাতেও একই সমস্যা থাকে।

কী কারণে হঠাৎই লোডশেডিং সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি পল্লী বিদ্যুৎ ও নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির কর্মকর্তারা। তীব্র লোডশেডিং-এ অতিষ্ঠ ঝালকাঠি জেলাবাসীও। জেলা শহর, নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলার পরিস্থিতি যেন ভয়াবহ। সারাদিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন জীবন পার করতে হয়। একদিকে গরম অন্যদিকে রমযান সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা। শ্রমিকরা জানান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে আমাদের কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে।

ওজোপাডিকোর একজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, কারিগরি ত্রুটির কারণে বেড়েছে লোডশেডিং। তিনি বলেন, আমাদের একটি সিটি বিস্ফোরণ হয়েছিলো। সেটি প্রতিস্থাপন করতে আমাদের ২ দিন সময় লেগেছে। এরপর লাইন আবার স্বাভাবিক করা হয়েছে।
এদিকে কুমিল্লা জেলা সদরে অন্তত ৭ থেকে ৮ বার লোডশেডিং হচ্ছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। কুমিল্লা নগরীতে বুধবার বিকেল ৫টা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৮ বার লোডশেডিং হয়েছে। লোডশেডিংয়ে হাসপাতালগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম।

সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় এখন ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। তিনটি কেন্দ্র বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলে লোডশেডিং বেড়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সিলেটে ৫১ ভাগের ওপর লোডশেডিং করা হয়েছে। ঈদের কেনাকাটা শুরুর পর লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ভবনে আগে জেনারেটর চালাতে ২০-৩০ লিটার ডিজেল লাগলেও এখন ৬০-৮০ লিটার লাগছে বলে জানিয়েছেন ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটির সহকারী ব্যবস্থাপক ।

বগুড়ায় অঞ্চলভেদে দিনে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় এ জেলায় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ঘাটতি থাকছে। বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আমজাদ হোসেন বলেন, চাহিদা ৮০ মেগাওয়াট। সরবরাহ মিলেছে ৬৫ থেকে ৭০ মেগাওয়াট। দিন-রাতে ১৫ শতাংশ সময় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সন্ধ্যা পার হলেই অন্ধকারে ডুবছে গ্রাম। একদিকে প্রচ- গরম, অপরদিকে এডিস মশার উৎপাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্যান ঘুরছে না; কিন্তু মশার কারণে অসহ্য গরমে থাকতে হচ্ছে মশারির ভেতর। সব মিলে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ গ্রামের মানুষ।

খবরে প্রকাশ-ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, নেত্রকোনাসহ দেশের অনেক জেলার চিত্রই এমন। এ পরিস্থিতিতে শুধু গ্রাহকই নন, লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ সংশ্লিষ্ট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশের প্রায় সব গ্রামে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দিনে চাহিদার তুলনায় ৬০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে। রাত ১০টার পর এর পরিমাণ আরও কমে। তখন লোডশেডিং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কোথাও কোথাও লোডশেডিং হয় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা। যদিও সরকারি হিসাবে উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে গড়ে ফারাক দেখানো হচ্ছে মাত্র ৭০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট। বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সিস্টেম লসও আগের মতো বেশি নয়। তাহলে গ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে কেন? বিদ্যুৎ তো আর জমা করে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে কি যে পরিমাণ উৎপাদন দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে সে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না?

উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে। মূল্যবৃদ্ধির বিনিময়ে জনগণ যেটা চায়, সেটা হলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। কাজেই গ্রামাঞ্চলে যে হারে লোডশেডিং হচ্ছে, এর দ্রুত অবসান হওয়া দরকার। সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।

পিজিসিবি’র হিসাবে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে ১ হাজার ৮৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। সন্ধ্যা ৯টায় সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৭০ মেগাওয়াট। ওই সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট। এ সময় ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট। অর্থাৎ তখন গ্রাহক পর্যায়ে ১১৯৯ মেগাওয়াট বা তারচেয়ে বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে।এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদা ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৬৯২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী দুই সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকো জানায়, সরবরাহ ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হচ্ছে না। তবে কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্র জানায়, তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে না। তাই বিতরণেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু স্থানে অপেক্ষাকৃত বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। চট্টগ্রামে লোডশেডিংয়ের অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের। লোডশেডিং কম বরিশাল বিভাগে।

পিডিবি’র কর্মকর্তারা বলেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম হওয়ায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দৈনিক অন্তত ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামাফিক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন হচ্ছে না। বর্তমানে সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৭-৮৮ কোটি ঘনফুট। গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে পেট্রোবাংলাকে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না। পিডিবির কাছে বড় অঙ্কের বকেয়া পড়েছে তাদের। ফলে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতেও খুব বেশি উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।

https://www.dailysangram.info/post/553399