৭ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১১:২২

ব্যাংক ও পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা : অস্ত্র লুট : ১৪টি বাসে আগুন : এসব কিসের আলামত?

-আসিফ আরসালান

ভারতীয় সমর্থনে বিরোধীদলকে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকার কৌশলগতভাবে কোণঠাসা করেছে ঠিকই, কিন্তু দেশে শান্তি আনতে পারেনি। বরং এই দুই মাসে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক অশান্তি ও হানাহানির চেয়ে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অস্থিরতা ও অরাজকতা তুমুলভাবে মাথাচাঁড়া দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছর ধরে তাদের সমস্ত মেধা এবং এনার্জি কনসেনট্রেট করেছে একটি বিষয়ের ওপর। সেটা হলো, কিভাবে বিরোধীদল তথা বিএনপি, জামায়াতকে সাইজ করা যায়। ১ লক্ষ মামলা দিয়ে, ৫০ লক্ষ মানুষকে আসামী করে, ২৬ হাজার মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তারা হয়তো ক্ষমতা সংহত করেছে। কিন্তু সমাজে শান্তি আনতে পারেনি। কারণ সেই দিকে তারা মোটেই নজর দেয়নি। সেজন্যই আজ দেখা যাচ্ছে সশস্ত্র ব্যক্তিদের ব্যাংক ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা। দেখা যাচ্ছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এসব দেখে মনে পড়ে যায় ’৭২ থেকে ’৭৫ এর অবস্থা। তখনও ঠিক এগুলিই ঘটছিল। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা, পাটের গুদামে অগ্নিকা-সহ তুমুল নাশকতামূলক কাজ। সেসবেরই সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে।

গত ১লা এপ্রিল রাজধানীর ডেমরায় গ্যারেজে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ১৪টি ভলভো বাস অগ্নিকাণ্ডে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসম্পর্কে যে খবর এসেছে তার সংক্ষিপ্ত সার হলো, রাতে ডিউটি শেষে এই বাসগুলো গ্যারাজ করা হয়। সারা রাত বাসগুলোর নিরাপত্তার জন্য একজন সিকিউরিটি গার্ড দায়িত্বে থাকে। কিন্তু এরমধ্যেও প্রথমে ২/৩ টি বাসে আগুন লাগে। আগুন লাগার খবর পেয়ে দমকল বাহিনী এবং পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। এরমধ্যে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে গ্যারেজে দাঁড়িয়ে থাকা ১৪টি বাসেই আগুন ধরে যায়। পত্র পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সুইডেনের ভলভো কম্পানির ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি এসব বাসের প্রতিটির পেছনে খরচ হয়েছে আড়াই কোটি থেকে তিন কোটি টাকা। এই হিসেবে ১৪টি বাস আগুনে পুড়ে যাওয়ার ফলে মালিকের ক্ষতি হয়েছে ৪২ কোটি টাকা। কম্পানির মালিক এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঘটনাস্থলে এসে ১৪ টি বাসের এই ধ্বংসাবশেষ দেখে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান এবং পড়ে যান। অতঃপর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

পুলিশ এবং দমকল বাহিনী এখন পর্যন্ত বলতে পারেনি যে কারিগরি ত্রুটির কারণে নাকি নাশকতার কারণে একটি নয় দুটি নয়, ১৪টি দামি ভলভো বাস পুড়ে গেল। তারা এর সঠিক কারণ এখনো তারা উদ্ধার করতে পারেনি। তবে তদন্ত নাকি চলছে। এই রকম অগ্নিকা- এবং জান ও মালের ক্ষতির কথা প্রায়শই পত্র পত্রিকায় আসে। তারপর তদন্তের কথা শোনা যায়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এরপর আর কোনো খবর থাকে না এবং মানুষও আস্তে আস্তে ঐ ঘটনা ভুলে যায়। কিন্তু একসঙ্গে ১৪ টি অত্যন্ত দামি বাসে আগুন লাগার ঘটনাকে এত হালকাভাবে নেওয়া হচ্ছে কেন? তাহলে কি সরিষার মধ্যেই ভূত আছে?

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে অগ্নিকা-ের কথা। এই অগ্নিকা-ে, যতদূর মনে পড়ে, ৪৫ জন আদম সন্তানের করুণ এবং অকাল মৃত্যু ঘটেছে। এতগুলো মানুষ মারা গেছে মাত্র দেড় থেকে দুই ঘন্টার মধ্যে। এসম্পর্কে পত্র পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। এসব ঘটনা সদ্য এবং তাজা। তাই এগুলোর বিস্তারিততে যাচ্ছি না। কিন্তু যেখানে দেড় দুই ঘন্টার মধ্যে ৪৫ জন মানুষের জীবন ঝরে পড়লো সেটির পরবর্তী ফলোআপ কি? ওখানে রেস্টুরেন্ট একাধিক ছিল। ৭ তলা ভবনটি ছিল আবাসিক। আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট থাকে কিভাবে? তাও আবার একটি নয়, কম করে হলেও তিনটি। আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্টের পারমিশন কে দিলো? কেউই দেয়নি এবং দেওয়া সম্ভবও নয়। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে বেআইনী। সেখানে আবার গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেই গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই অগ্নিকা-ের উৎপত্তি। প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর ধরে এক সময়ের পোশ এরিয়া বেইলি রোডে বহুতলা আবাসিক ভবনে একাধিক রেস্টুরেন্ট চলছে, কেউ তার খবর রাখল না? সিটি কর্পোরেশনের অনেক আইন আছে। কিন্তু সেসব আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা সেটা মনিটর করবে কে? সেটাও অবশ্যই মনিটর করবে ঐ সিটি কর্পোরেশনই। কিন্তু সেটি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে সিটি কর্পোরেশন এই ব্যাপারে উদাসীন থেকেছে। অথবা তাদের নজরে এলেও পয়সা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। উদাসীনতা অথবা টাকার খেলার কাছে ৪৫ জন শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নর নারীর জীবন বলী হয়ে গেল। টকশোতে অনেকে বলছেন, এটি একটি হত্যাকা-। কারণ ঐ ভবনের কোনো কোনো বাসিন্দা নাকি রেস্টুরেন্ট থাকার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু তাদের আপত্তি কেউ আমলে নেয়নি। শুধু রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বা অন্য কর্মচারীকে গ্রেফতার করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? সিটি কর্পোরেশনের গাফেল অফিসার বা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এখন আর ঐ খবর পত্র পত্রিকায় নাই। মানুষ আবার ঐ ঘটনা ভুলে যেতে বসেছে।

॥ দুই ॥
পত্র পত্রিকার খবরে প্রকাশ, গত ৩০ মার্চ নোয়াখালী সদর উপজেলার এওজবালিয়া ইউনিয়নের মান্নান নগর বাজারে অজ্ঞাত কারণে ৭ টি দোকানে আগুন ধরে যায়। অগ্নিকা-ে ৭ টি দোকানই পুড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কমপক্ষে ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিভাবে এই ৭ টি দোকনে আগুন লাগলো সেসম্পর্কে কোনো তথ্য পরবর্তীকালে জনগণকে আর জানানো হয়নি।
গত ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম নগরের টেক্সটাইল মোড়ে অবস্থিত একটি জুতা তৈরির কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় কারখানাটির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ফায়ার স্টেশনের কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হয় যে একটি ৬ তলা ভবনে জুতার দোকানটি অবস্থিত। ৬ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রথমে আগুন লাগে। তারপর সমগ্র বিল্ডিংয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বলা হয়েছে, আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে দমকল বাহিনী ব্যাপৃত রয়েছে। এর পরের খবর আর জানা যায়নি।

গত ৪ মার্চ সোমবার কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগরের মইজ্জারটেকে অবস্থিত এস আলম সুগার মিলে অগ্নিকা- ঘটে। এই অগ্নিকা- এত ভয়াবহ ছিল যে দমকল বাহিনীর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অগ্নি নির্বাপণ করতে ৬ দিন সময় লাগে। এই রিফাইনড সুগার মিলে ১ লক্ষ টন চিনি ছিল বলে মিল কর্তৃপক্ষ দাবি করেন। এই অগ্নিকা- সম্পর্কেও বিস্তারিত জানানো হয়নি। শুধু অগ্নিকা-ের ক্ষয় ক্ষতি এবং দমকল বাহিনীর তৎপরতা পত্র পত্রিকায় হাইলাইট করা হয়েছে। কিন্তু কেন এই অগ্নিকা- ঘটলো, কারা এর জন্য দায়ী, এসম্পর্কে কোনো তদন্ত করা হয়েছে কিনা এবং করা হয়ে থাকলে তার ফলাফল কি সে সম্পর্কে জনগণকে কিছুই জানানো হয়নি।
খুলনার রূপসায় ব্যক্তিমালিকানাধীন সালাম জুট মিলে গত ৩ এপ্রিল বুধবার বিকালে ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস ও নৌবাহিনীর ১৬টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন করা হয়। আগুনে শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে মালিকপক্ষ। পাটকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, বুধবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে উপজেলার জাবুসা গ্রামে অবস্থিত কারখানাটিতে হঠাৎ আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের খুলনার বয়রা, টুটপাড়া, রূপসা ও বাগেরহাটের ফকিরহাট থেকে ১৪টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় নৌবাহিনীর দুটি ইউনিট। রাত সাড়ে ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আগুনে অনেক পাট পুড়ে গেছে।

॥ তিন ॥
এখানেই শেষ নয়। গত ২ মাসে এই ধরনের আরো অনেক অশুভ ঘটনা ঘটেছে। স্থানাভাবে আমরা আর মাত্র দুইটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করবো। গত বুধবার ৩ এপ্রিল রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সশস্ত্র হামলা হয়। ঘটনার বিবরণে প্রাকাশ, সশস্ত্র ডাকাত দল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবাসিক ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করে। তাদের বাধা দিলে অস্ত্রধারীরা গেটে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের উপর হামলা করে। নিরাপত্তাকর্মীদের চিৎকারে আনসার সদস্যরা ছুটে গেলে, ডাকাতরা আনসার সদস্যদের উপরও হামলা করে। আত্মরক্ষার্থে আনসার সদস্যরা গুলি চালায়। এতে ডাকাতরা পিছু হটে। তাদের হামলায় দুই আনসার সদস্যসহ ৫ জন আহত হয়েছে। তাদের উদ্ধার করে রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে দুইজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অপর ৩ জনকে রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে বান্দরবানে। গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ৮ টায় সোনালী ব্যাংকে ৯০ থেকে ১০০ জনের একটি সশস্ত্র দল হামলা করে। তারা ভল্টের চাবি না পেয়ে ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পরদিন ম্যানেজারকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু ঐ একই দিন সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় সশস্ত্র হামলা হয়। বুধবার বেলা ১ টায় থানচি নামক জায়গায় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলা হয়। এসব হামলায় ১৭ লাখ টাকা লুট করা হয়েছে এবং ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪১৫ রাউন্ড গুলি লুট করা হয়েছে। মাত্র ১৭ ঘন্টায় দুই ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা করা হয়। সরকার বলছে, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামক একটি সশস্ত্র দল এই হামলা করেছে। পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে যে টাকা পয়সা লুট করা হামলাকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না। থানচির পর গভীর রাতে তারা আলীকদমে হামলা করে। পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে পুলিশ ৫০০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে। খবরটি অতি সাম্প্রতিক। তাই আর বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না। কিন্তু একথা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে অস্ত্র লুটই ছিল এসব হামলার উদ্দেশ্য।

আমরা শুরুতেই বলেছি যে ’৭২ থেকে ’৭৫ এও এই ধরণের হামলা হয়েছিল। তখনও ব্যাংক, পাটের গুদাম, পুলিশ ফাঁড়ি প্রভৃতিতে হামলা হয়। এখনও সেগুলিই ঘটছে। সরকার কোনো ব্যাপারেই পরিষ্কার কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। কারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, কি তাদের উদ্দেশ্য, সেসম্পর্কে দেশবাসীকে কিছুই জানানো হচ্ছে না।

কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমরা যে মেঘ দেখছি সেটি যেন সিঁদুরে মেঘ না হয়।
Email: asifaraslan15@gmail.com

https://www.dailysangram.info/post/553337