৬ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৮:৪৩

নির্বাচন পূর্ব মানবাধিকার ও গণমাধ্যম

-ইবনে নূরুল হুদা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ব আমাদের দেশের মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন ছিল তা সে সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে ওঠে এসেছে। এসব বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জ্ঞাত হওয়া গেছে, দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে ধরনের পরিবেশ, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন তার কিছুই ছিল না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল তেমনটিই হয়েছে। সরকারের নানা ধরনের রাখঢাক কোন কাজেই আসেনি। ফলে পর্বত মুসিকও প্রসব করতে পারেনি। যা পুরো জাতির জন্যই ছিল দুর্ভাগ্যজনক।

মূলত, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যম একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক। আর গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের অন্যতম চালিকাশক্তি। কোন সমাজে ভিন্নমতের অনুশীলন ও চর্চা না থাকলে সে সমাজকে সভ্য বা গণতান্ত্রিক বলা যায় না। রাষ্ট্রের সকল শ্রেণি, পেশা, দলমত ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শনও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আওতাভুক্ত। দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায়, ‘আমি তোমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমি জীবন দিতেও কুন্ঠিত নই’। মূলত, এটিই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আধুনিক সভ্যতার মানদ-। আর পরমত সহিষ্ণুতা গণতন্ত্র ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ; একটি অন্যটির সাথে অবিচ্ছেদ্য। স্বাধীন গণমাধ্যম এক্ষেত্রে অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
আধুনিক বিশ্বকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব মনে করা হয়। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানেরও অন্যতম মূলনীতি। গণতন্ত্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যম। যার মাধ্যমে মানবাধিকার বিকশিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও আমাদের দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ফলে গণতন্ত্রও বিকশিত হতে পারেনি। মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও আমরা বেশ পশ্চাদপদ। সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার বড় ধরনের অবনতিই ঘটেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন আইনী মারপ্যাচে দেশের গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত করার অভিযোগ উঠেছে জোরালোভাবে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় সব সূচকেই পরিস্থিতির উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানবাধিকারের বিষয়টিও রীতিমত তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফলে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রীতিমত তলানিতে এসে ঠেকেছে।

সঙ্গত কারণেই সদ্যসমাপ্ত সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় উদ্বেগ জানায় ৬টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস-এর ওয়েবসাইটে যৌথ বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানান হয়।

সংগঠনগুলো হলো- রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস (আরএফকেএইচআর), ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট (সিপিজেপি), দ্য ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম (ইউএটিসি), এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস (এএফএডি), এন্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএএন) এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস (আইসিএইডি)। বিবৃতি তারা জানায়, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং নাগরিক সমাজের স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখায় ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু আহ্বান কোনভাবেই মূল্যায়িত হয়নি।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিরোধীদের দমন করতে সহিংসতার আশ্রয় নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এ বছর অক্টোবরের শেষের দিক থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের সমন্বিত র‌্যালি ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। এসব প্রতিবাদকারী ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকে দমন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সহিংসতা ফিরিয়ে এনেছে। এই দমনপীড়নে একজন সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন বিরোধী দলের ৮ হাজার ২৪৯ জন নেতা। এছাড়াও হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আয়োজিত মানববন্ধনে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ সব ঘটনায় জরুরি ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অতিমাত্রায় কাঁদানে গ্যাস, লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ব্যবহার এবং একই রকম অন্যান্য ব্যবস্থার ব্যবহার উদ্বেগকে গুরুতর করে তুলেছে বলে বিবৃতিদাতারা মনে করেন। এতে বলা হয়, পুলিশের এসব অস্ত্রের অপব্যবহার মোকাবিলায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এসব অস্ত্রের অযৌক্তিক ব্যবহার শুধু নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারই লঙ্ঘন করে এমন নয়। একই সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে। সৃষ্টি করে এমন একটি পরিবেশ, যা ভিন্নমতাবলম্বী, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং গণতান্ত্রিক আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জরুরি ভিত্তিতে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের ‘বেসিক প্রিন্সিপালস অন দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ারআর্মস বাই ল এনফোর্সমেন্ট অফিসিয়ালস’ এবং জাতিসংঘের ‘হিউম্যান রাইটস গাইডেন্স অব লেস-লেথাল উইপন্স ইন ল এনফোর্সমেন্ট’।

‘অক্টোবরের শেষ দিকে বাংলাদেশ সরকার গণহারে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে আটক করেছে, যারা বিরোধী দলের বা বিরোধী দলের সমর্থক হিসেবে মনে করা হয়। ৮৩৪টি মিথ্যা মামলার অভিযোগে এদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বৈধ প্রেক্ষাপট থাকা সত্ত্বেও অব্যাহতভাবে এসব মামলায় জামিন অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। যথাযথ প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তাকেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতনের এই অভিযোগ শুধু গত মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আগেও একই রকম অভিযোগের প্রতিবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রহার, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে দেয়ার মতো দৃশ্য তৈরি করা-হাঁটুর নিচে গুলী করা, ভুয়া মৃত্যুদ- কার্যকরের দৃশ্য তৈরি করা এবং জোরপূর্বক নগ্ন করা’ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

গণহারে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নেতাদের অভিযুক্ত করতে সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের হেভিওয়েট প্রার্থীদের অযোগ্য করতে রাতেও আদালতে বিচার করছে। এগুলো কয়েক মাস আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। গণহারে এই আটক এবং অভিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সততা এবং সুষ্ঠু বিচারের অধিকারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে এমন না। একই সঙ্গে পুরো পরিবারকে সীমাহীন হতাশায় ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আটক ব্যক্তি তার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

সহিংসতা ও নির্বিচারে আটক বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, জনগণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করছে যখন, তখন এসব নির্যাতন করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের মৌলিক মূলনীতিকে সমুন্নত করার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার সহিংস ও দমনপীড়নের মতো পদক্ষেপ ব্যবহার করছে। তাতে ভয়, উদ্বেগ এবং নাগরিকদের জন্য চরম অনিরাপদ এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই সহিংস দমনপীড়নের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন- ‘বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার, কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী গণহারে গ্রেফতার, কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া, প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদেরকে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও বেআইনি আটকের ঘটনা বৃদ্ধিতে তারা গভীরভাবে হতাশ।

এছাড়াও বিবৃতিতে ডাটা সুরক্ষা আইনকে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নাগরিকের ডাটায় বাধাহীন প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। যদি জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরোধ অথবা কোনো অপরাধ শনাক্ত হয় বলে মনে হয়, তখনই তারা এটা ব্যবহার করতে পারবে। এই ক্ষমতার অপব্যবহারে ব্যাপক বিস্তৃত নজরদারি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের। এর ফলে মানবাধিকার, বিশেষ করে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যের বিষয়ে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে এসব ডাটা সংগ্রহ করা হবে এবং ডাটার সুযোগ প্রয়োজন হবে-তা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে সময়োপযোগী নিরপেক্ষ বিচারিক পর্যালোচনা প্রয়োজন।

জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদের শেষ বছরে ৩৬৫ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন, আর খুন হয়েছেন ২ জন। এ ছাড়া ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০২৩’ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে এইচআরএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা ৫৮ মামলায় ১৮৮ জনকে আসামী করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ৬০ জন। দেশের ১২টি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের এই মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

২০২৩ সালে ৯৩৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে এইচআরএসএস বলেছে, এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৬ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯ হাজার ২৫৮ জন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল, নির্বাচনী সহিংসতা এবং বিএনপির পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পাল্টা শান্তি সমাবেশকেন্দ্রিক সংঘর্ষে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ৮ হাজার ৫৫৬ রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৪৫৬টি মামলায় ১৪ হাজার ৪০০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৫৮ হাজার ৯৪০ জনকে অজ্ঞাত আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। নির্বাচনী সহিংসতার ২৫৬টি ঘটনায় ৯ জন নিহত হওয়ার কথাও জানিয়েছে এইচআরএসএস। সংগঠনটি বলছে, ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচনী সহিংসতার ১৮৭টি ঘটনায় ৫ জন নিহত ও কমপক্ষে ৯০২ জন আহত হয়েছেন।

২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেমে ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয় এইচআরএসএসের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৩৩ জন। এর মধ্যে ৭ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে, ৭ জন নির্যাতনে এবং ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৫ জন মারা যান। এছাড়া কারা হেফাজতে ৮৪ জন মারা গেছেন। শুধু ডিসেম্বর মাসেই কারা হেফাজতে ১৫ জন মারা যান। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ৮ জন রয়েছেন।

এখানেই শেষ নয়। ২০২২ সালের রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর সূচককে ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম বলে জানা গেছে। ২০২১ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২। সে হিসাবে এবার এক বছরেই ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে শীর্ষ দশটি দেশের নয়টিই ইউরোপ মহাদেশের। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সবচেয়ে এগিয়ে নরওয়ে। তারপর ক্রমান্বয়ে এসেছে ডেনমার্ক, সুইডেন, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, কোস্টারিকা, লিথুয়ানিয়া এবং লিশ্টেনস্টাইনের নাম রয়েছে।

একথা বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয় যে, আমাদের দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আরএসএফ’ প্রকাশিত ২০২০-এর রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১৫১তম স্থানে-যা এর আগের বছর ছিল ১৫০তম স্থানে। ২০১৮ সালে ছিল ১৪৬তম স্থানে। এতে প্রমাণ হয় গণমাধ্যমের স্বাধীন পথপরিক্রমা ক্রমেই অমসৃণ হয়ে উঠছে। ফলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রশ্নবিদ্ধই রয়েছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সক্রিয় এই সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বৈশি^ক মহামারি করোনার মধ্যেও বাংলাদেশে অন্তত ৮ জন সংবাদমাধ্যম কর্মীকে পুলিশসহ অন্যরা আক্রমণ করে গুরুতর আহত করেছে। বিভিন্ন আইনে মামলা হয়েছে অন্তত ৯ জনের বিরুদ্ধে। ডিটেনশনে দেয়া হয়েছে ৫ জনকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কর্মরত অপর আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’ বা সিপিজে বাংলাদেশের বিদ্যমান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ বাংলাদেশে কমপক্ষে ২০ হাজার ওয়েবসাইট ব্লক এবং অনলাইন মাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধ এবং নজরদারীর কথা জানিয়েছে।

এমনকি দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রসহ অনেক সংস্থাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিম্নমুখী পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও সংশ্লিষ্ট পত্রিকার রিপোর্টার শামসুজ্জামান শাসম বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতার সে অভিযোগকে নতুন মাত্রা দেয়। যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় বলে মনে করছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের গণমাধ্যম অতীতে যেমন শৃঙ্খলমুক্ত ছিল না; এখনও নয়। সে ধারাবাহিকতায় অতীতে The Newspaper (Announcment Of declaration) Act-1975 -১৯৭৫ এর মাধ্যমে মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল। যা কারো অজানা নয়।

https://www.dailysangram.info/post/553255