৩০ মার্চ ২০২৪, শনিবার, ১:০১

বছরের পর বছর যায় অবসর ভাতা মেলে না

‘ও বাবা, কী করব, বাবা? ভাগ্য রে বাবা...এডা কিন্তু ঘুষের টেহা না। আমার হক টেহা, বাবা! আমি যদি মইরাও যাই বাবা, তুই টেহা পাবি। কপাল মন্দ, ঈদের আগে টেহা পাইলাম না, বাবা।’

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর নীলক্ষেতে ব্যানবেইস ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ছেলের উদ্দেশে মোবাইল ফোনে বলছিলেন নূর মোহাম্মদ।

তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি স্কুল শিক্ষক। এসেছেন ওই ভবনে থাকা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড দপ্তরে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কচাকাটা ইউনিয়ন থেকে অবসরকালীন ভাতার টাকা তুলতে এসেছেন এই শিক্ষক। কিন্তু টাকা পাননি।

তাই ছেলেকে ফোন করে হতাশা প্রকাশ করছিলেন তিনি।

এই প্রতিবেদক তখন তাঁর পাশে দাঁড়ানো। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে ঘামছিলেন এই অবসর নেওয়া শিক্ষক।
নূর মোহাম্মদ জানান, গত বছর আগস্ট মাসে অবসরে যান।

দীর্ঘ চাকরিজীবনে বেতনের ৬ শতাংশ অর্থ অবসর ভাতা বাবদ কাটা হয়েছে। সেই অর্থসহ এখন তিনি অবসর ভাতা পাবেন ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দ্রুত এই অর্থ পাওয়ার আশায় দালাল ধরেও লাভ হয়নি তাঁর।

নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমিসহ চাইরজন গত বছর অবসরে গেছি। বাকিরা টেহা নিয়া গেছে।

একজন কইল ১৫ হাজার টেহা দিলে কাজ অইব। দিলাম টেহা। তারপর সে খালি কয় অইব, অইব। কিন্তু আর অয় না। এহন নিজেই এহানে আইছি। আইয়া দেহি, আমার নামে কোনো ফাইলই করে নাই। আমার কপালই মন্দ। হাইকোর্ট নাকি ছয় মাসের মইধ্যে টেহা (অবসর ভাতা) দিবার কইছে। আর স্যারেরা কয়, টেহা পামু তিন বছর পর!’

শুধু নূর মোহাম্মদ নন, প্রতিদিন এমন শত শত ভুক্তভোগী ভিড় করেন অবসর বোর্ড দপ্তর প্রাঙ্গণে। পাওনা অর্থ পেতে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির দালাল। দ্রুত অবসর ভাতা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে অসহায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবসর ভাতার জন্য আবেদন করে টাকা না পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে যাঁরা অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন, প্রায় তিন বছর পর তাঁদের অর্থ বিতরণ করছে অবসর বোর্ড। ভুক্তভোগীদের অবসর ভাতা পেতে ন্যূনতম তিন থেকে পাঁচ বছর পার করতে হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি সময় চলে যায়।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব শরীফ আহমদ সাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তির বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। প্রতিদিনই তাঁদের করুণ পরিস্থিতি দেখছি। তবে আর্থিক সংকটের কারণে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে হাইকোর্টের দেওয়া ছয় মাস নয়, বরং ছয় দিনেই ভুক্তভোগীদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব। এই খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। আশা করছি, দ্রুত এর সমাধান পাওয়া যাবে।’

শরীফ আহমদ সাদী বলেন, ‘এই সংকটের কারণে দালালরা সুযোগ নিচ্ছে। আবার ভুক্তভোগীরাও সহজেই তাদের খপ্পরে পড়ে। অবসর ভাতার আবেদনসহ সামগ্রিক ধাপগুলো পর্যবেক্ষণে আমরা বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপ খুলেছি। এ ছাড়া আমাদের দুটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে। শিক্ষক-কর্মচারীরা চাইলে খুব সহজেই নিজেরা অবসর ভাতার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে পারেন। আমরা সব সময় দালাল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিই। এ নিয়ে লিফলেটও বিতরণ করছি।’

প্রায় পাঁচ বছর ধরে অবসর ভাতার জন্য ঘুরছেন চাঁদপুরের একটি বেসরকারি স্কুলের সাবেক সহকারী শিক্ষক নিজামুল হক। ২০১৯ সালে অবসরে যান তিনি। এর পর থেকে নিয়মিত যাতায়াত করছেন নীলক্ষেতের এই অবসর বোর্ড কার্যালয়ে।

নিজামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই নিয়া ১০ থেকে ১২ বার আসছি। জীবনের শেষ পর্যায় আইসা এতবার যদি কষ্ট হয়, তাহলে কেমন লাগে বুঝতেই পারছেন! আবেদনের কাগজে নাকি ভুল ছিল। কাগজগুলো ঠিক করে এখন কনফার্ম হতে আসছি। তারা বলছে, ব্যাংকে যোগাযোগ রাখতে, টাকা পেতে দুই থেকে চার মাস সময় লাগতে পারে। এখন ভাগ্যে যদি থাকে, তাইলে পাব। টাকা পাওয়া পর্যন্ত বাঁচলেই হয়।’

হিসাব অনুযায়ী, আবেদন করেও অবসর ভাতা না পাওয়া ৩৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর পাওনা পরিশোধে প্রয়োজন প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতিবছর যতসংখ্যক শিক্ষক অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন, তার তুলনায় অর্থের জোগান কম। ফলে বছরে আরো অন্তত ৪২০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

অবসর বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, প্রতি মাসে অবসর ভাতার জন্য আবেদন করেন গড়ে ৯০০ জন শিক্ষক-কর্মচারী। যাঁদের পাওনা মেটাতে প্রয়োজন অন্তত ১১০ কোটি টাকা। অন্যদিকে টাকার উৎস হিসেবে ব্যাংকে ডিপোজিট করা আছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। সেখান থেকে প্রতি মাসে লভ্যাংশ আসে প্রায় তিন কোটি টাকা। শিক্ষকদের বেতনের কর্তন করা ৬ শতাংশ থেকে আসে আরো ৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ অবসর ভাতা বাবদ এক মাসে ৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব। এতে নতুন করে প্রতি মাসে ৩৫ কোটি টাকা বা বছরে ৪২০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/03/30/1375831