২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৩৩

ঈদ সামনে রেখে বেড়েছে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য

পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রাজধানীতে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রতিবছরই বড় উৎসবকে সামনে রেখে বাহারি নামের অপরাধীরা সক্রিয় হয়। বিশেষ করে মৌসুমি অপরাধীরা বেশি তৎপর হয়। এমনকি উৎসবকে ঘিরে এসময় নগরীর বাইরে থেকেও অপরাধীরা ঢাকায় এসে সংঘবদ্ধ হয়।

বাহারি নামের অপরাধী চক্রের মধ্যে আছে অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, থুথুপার্টি, ধাক্কাপার্টি, পা পাড়াপার্টি, ল্যাং মারাপার্টি, ঢিলপার্টি, হাফপ্যান্টপার্টি, টানাপার্টি, ছোঁমারাপার্টি, ডলারপার্টি, লাগেজপার্টি ইত্যাদি। রাজধানীতে এ ধরনের নামের এক ডজনেরও বেশি অপরাধী চক্র সক্রিয়।

এসব অপরাধীরা এখন বড় বড় বিপণি বিতানের সামনে সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে এসময় শপিংমল এলাকার অপরাধীরা ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। শুধু তাই নয়, ঈদ মৌসুমে অপরাধী চক্র জালটাকা ছাড়ানোর পাঁয়তারা করে। এ ব্যস্ত সময়ে কেনাকাটার ভিড়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে জাল নোটের কারবারিরা। অনলাইনে পেজ খুলে এসব জালটাকার ডেলিভারি দেয় তারা।
সরকারি ছুটির তালিকা অনুযায়ী এবছর দীর্ঘ হতে পারে ঈদের ছুটি। গত বছরের চেয়ে এবার কিছুটা আগেই ফাঁকা হতে পারে রাজধানী ঢাকা। এবার রমযান মাস ৩০ দিন হলে, ঈদুল ফিতর হবে ১১ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার)। আর ১১ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের তারিখ নির্ধারণ করে ছুটির তালিকা করেছে সরকার। সে হিসেবে এবারের ঈদে অন্তত ৫ দিন ছুটি ভোগ করতে পারবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। ঈদের ছুটির আগেই রাজধানীর বড় বড় শপিং মল, বাণিজ্যিক বিতান, পাইকারি ও খুচরা বাজারে বেচাকেনা বেড়ে গেছে। এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, অজ্ঞান ও মলমপার্টির সদস্যরা তৎপরতা শুরু করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন কর্মকর্তা জানান, ঈদের সময়ের চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে বিপণিবিতান, রাস্তা-ঘাটে, টার্মিনালে এই ধরনের অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকেই রিক্ত, নিঃস্ব, আহত, নিহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমার, প্রতারণাসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে বেড়ায় বাহারি নামের অপরাধী চক্র। লঞ্চ টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনালের মতো স্থানে টানা পার্টি, থুথু পার্টি, ল্যাং মারা, পা পাড়া পার্টির দৌরাত্ম্য বেশি দেখা যায়। এসব অপরাধী গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়। দলবদ্ধ হয়ে কোন ব্যক্তিকে ঘিরে ধরে নানা কৌশলে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে সর্বস্ব কেড়ে নেয় তারা। এসব অপরাধী চক্র সংঘবদ্ধ, দলবদ্ধ। এ কারণে অপরাধীদের প্রতিরোধ করতে পারেন না পথচারীরা। প্রকাশ্য দিবালোকে ওদের তৎপরতা। কখনও কেউ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পথচারী মানুষের সামনেই উল্টা প্রতিরোধকারীকেই অপরাধী বানিয়ে দেয় এমন নজির অসংখ্য। দেখা যাচ্ছে, ইচ্ছা করে অপরাধী চক্রের কোন একজন পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধায়। এরপর অপরাধী চক্রের অপর সদস্যরা এসে ঝগড়া বাধানোর শিকার নিরীহ পথচারী ব্যক্তিকে ঘিরে ফেলে। উল্টা নিরীহ পথচারী ব্যক্তিকেই অপরাধী বানিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীরা বিপদের আশঙ্কায় দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়। আর এভাবেই অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, ল্যাং মারা পার্টিসহ বিভিন্ন পার্টি ছিনিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ রাজধানীর নিউমার্কেট, গুলিস্থান, জয়কালী মন্দির, ফকিরাপুল, কুড়িল বিশ্বরোড, উত্তরা, জুরাইন, মগবাজার মোড়, ফকিরাপুল ও মৌচাকসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে এসব অপরাধীদের। গ্রেফতারের পর তারা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সারা বছর তাদের কর্মকান্ড চালালেও ঈদ ও রমযানকে গুরুত্ব দিয়ে টার্গেট করে থাকে। প্রথমে তারা রোজাদার ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। ইফতারের আগ মুহূর্তে টার্গেট ব্যক্তিকে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে আগে তৈরি করা খাবার খাওয়ায়। যখন ওই ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়ে তখন তার সর্বস্ব লুটে নিয়ে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন সময় গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ইফতারের কিছু আগে একজন বাসযাত্রীকে টার্গেট করে তার পাশে বসে। কথায় কথায় সখ্য তৈরি করে। মাগরিবের আজান শুরু হলে বাসযাত্রীকে ইফতারের খাবার খাওয়ান প্রস্তাব দেয়। ওই খাবারে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো থাকে। বাসযাত্রী ওই খাবার খেলেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বাসে যেসব হকার খাবার বিক্রি করে তাদের মধ্যেমেও চেতনানাশক মেশানো খাবার বাসযাত্রীদের কাছে বিক্রি করে থাকে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও অনেক সময়ে মলম পার্টি বা বাহারি নামের অপরাধী চক্র সেজে অপরাধ করে বেড়ায়। সারা বছর ধরে তারা বাহারি নামে অপরাধ করে বেড়ালেও ঈদকে সামনে রেখে রমযান মাসে তাদের অপরাধী তৎপরতা কয়েকগুন বেশি বেড়ে যায়।

ডিবির তালিকা থেকে জানা গেছে, অপরাধ সংঘটিত করার ধরনের সঙ্গে অপরাধী চক্রের নামের সাদৃশ থাকায় এসব নামকরণ করা হয়েছে। যেমন অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির নাম ব্যাপক তৎপরতার কারণে খুবই পরিচিত লাভ করেছে অপরাধ জগতে। কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব খুইয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে নামকরণ হয়েছে অজ্ঞান পার্টির। তেমনি চোখে মলম দিয়ে জোর করে ছিনিয়ে নেয়ার অপরাধীদের নাম দেয়া হয়েছে মলম পার্টি। হাফ প্যান্ট পার্টি সাধারণত রাতের বেলায় ডাকাতি করে বেড়ায়। ডলার পার্টি লোভ দেখিয়ে কম দামের ডলার বা টাকা দেয়ার নাম করে জাল নোট দিয়ে সটকে পড়ে। ডলার পার্টির কাজ হচ্ছে স্রেফ প্রতারণা। ঢিল পার্টি গাড়িতে ঢিল ছুঁরে গাড়ির গতিরোধ করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। ছোঁ মারা পার্টি চলন্ত রিক্সা বা হোন্ডা কিংবা বেবিট্যাক্সি আরোহীদের ছোঁ মেরে ছিনতাই করে নিয়ে দ্রুতগতিতে অদৃশ হয়ে যায়। আবার ধাক্কা পার্টি আছে, যারা গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে অপরাধীরা দলবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধকারীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়।

ডিএমপি জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন টিম বাহারি নামের অপরাধ দমনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ডিবির নেতৃত্বাধীন টিমগুলো রাজধানীর এসব অপরাধীদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাহারি নাম পেয়েছে। প্রতিটি অপরাধী দলে ৫ থেকে ৭ জন করে সদস্য থাকে। একজন দল নেতা তাদের নেতৃত্ব দেয়। রাজধানীতে প্রায়ই পথচারী, রিক্সা বা সিএনজি আরোহীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজন এসব বাহারি নামের অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ে। তবে এই সব অপরাধ খুব বড় ধরনের না হওয়ায় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের শরণাপন্ন হন না। এ কারণে এই ধরনের অপরাধী চক্রের তৎপরতার বিষয়গুলো থানা পুলিশের খাতায় রেকর্ডও হয় কদাচিৎ। লাগেজ পার্টি কিভাবে কোথায় অপরাধ সংঘটিত করে তার কথা কম বেশি জানেন আকাশ পথের যাত্রীরা।
ডিএমপি বলছে, ঢাকা মহানগরের সব এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির তৎপরতা ঠেকাতে মাঠে রয়েছে পুলিশ সদস্যরা। যে নামেই চাঁদা আদায় করুক, সব ধরনের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া রাজধানীর বড় বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র, শপিং মলে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এসব এলাকা চিহ্নিত করে ইউনিফর্মে ও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।
তবে এর মাঝেও গতকাল বুধবার সকালে আল আমিন নামের একজন সৌদি আরবগামী ব্যক্তি মেডিকেল পরীক্ষার জন্য ঢাকায় এসে প্রতারকদের খপ্পরে পড়েন। এসময় পুলিশ পরিচয়ে তাকে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশায় তোলেন রাজু ও নাজমুল। পরে তার কাছে থাকা ১২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেন। এসময় আল আমিন চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে তাদের আটক করে। পরে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে তেজগাঁও থানা পুলিশ তাদের আটক করে। গ্রেফতাররা হলেন-মো. রাজু (৫২) ও মো. নাজমুল (৫০)। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কলমিলতা মার্কেটের সামনে থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে গত সোমবার সকালে সেনাবাহিনীর এক সাবেক সদস্য মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি চক্র ঈদকে টার্গেট করে অপহরণ মিশনে নামে। মাওয়া থেকে ডিবি পরিচয়ে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ নিয়ে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় ফেলে যায় তারা। এরপর পুরান ঢাকা হয়ে মুন্সিগঞ্জে ফেরার পথে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূল হোতাসহ চার জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, চাপাতি, দা, ডিবি পুলিশ লেখা স্টিকার, সাংবাদিকের পরিচয়পত্র, দড়ি, গামছা, মোবাইল সেট, সুইচ গিয়ার, খেলনা পিস্তল ও হ্যান্ডকাফ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, মিজান ও তার সহকারীরা মূলত ঈদকে টার্গেট করে অপহরণ মিশনে নামে। অপহরণ করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয় তারা। তবে তারা এখন পর্যন্ত কতজনকে অপহরণ করেছে সেই বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। একই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দেশীয় অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ৫ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১০)। র‌্যাব জানায়, এরা সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য। রাজধানীর মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চুরি ও ডাকাতি করে আসছিল তারা। গত ২০ মার্চ রাতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিভিন্ন স্থানে বাস, পণ্যবাহী ট্রাক থামিয়ে ডাকাতি করার সময় সংঘবদ্ধ আন্তজেলা ডাকাত দলের মূলহোতা হৃদয় ওরফে চাক্কু হৃদয়সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪। সংস্থাটি জানায়, ৭-৮ জনের ডাকাত দল প্রায়শই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ছুরি ও চাকুসহ অবস্থান করে। তাদের টার্গেট বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক বা লরি। গভীর রাতে কিছু যানবাহনের ড্রাইভাররা রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম করে। সেই সুযোগে গাড়ির ড্রাইভার-হেলপারকে জিম্মি করে মালামাল ডাকাতি করে আসছিল চক্রটি। এছাড়া ড্রাইভার-হেলপারকে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকাও দাবি করে আসছিল তারা।

https://dailysangram.info/post/552473