২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ২:৩৭

অর্থপাচার বেড়েই চলছে

৮৫ শতাংশই হয় আমদানি-রফতানির আড়ালে : সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬৫ শতাংশ

দেশ থেকে অর্থপাচার কোনোভাবেই থামছে না, বরং দিন দিন তা বেড়েই চলছে। বেশির ভাগ অর্থপাচার হচ্ছে আমদানি-রফতানির আড়ালে। একই সাথে ব্যাংকে বেড়েছে সন্দেহজনক লেনদেন। দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বলছে, দেশ থেকে অর্থপাচারের ৮০-৮৫ শতাংশই হচ্ছে আমদানি-রফতানির আড়ালে। ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে ‘আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসের’ মাধ্যমে এসব অর্থপাচার হয়। ব্যাংকারদের অসহযোগিতা থাকলেও ১৭টি তথ্য প্রদানকারী সংস্থার সহায়তায় আগের বছরের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত হয়েছে। আর বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা জটিল হলেও অর্থ ফেরত আনা ও সহযোগিতার জন্য নতুন করে ১০টি দেশের সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করা হচ্ছে।

অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে বিএফআইইউর সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে অতিথি ছিলেন বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। এ ছাড়া বিএফআইইউর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম, বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের পরিচালক সারোয়ার হোসেন, বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইনসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বিএফআইইউ প্রতিবেদন তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি। এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৫ হাজার ৫৩৫টি, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৬৫ ভাগ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সব সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত করি। এর পর যদি কোনো অপরাধের তথ্য প্রমাণ মিলে তা হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।

বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, অর্থপাচারের ৮০ শতাংশ হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে তা হলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ একবার অর্থপাচার হয়ে গেলে তা ফেরত আনা যায় না। তিনি জানান, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা ও সহযোগিতার জন্য ১০টি দেশের সাথে এমওইউর করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বিএফআইইউর প্রধান বলেন, বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে অর্থপাচারের মামলা হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডির ১০টি এবং এনবিআরের বিশেষ সেল দুইটি। এগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বাণিজ্যের (আমদানি-রফতানি) আড়ালে ব্যাংকিং চ্যানেলে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছে। এর মাধ্যমে পণ্যমূল্যের চেয়ে বেশি দেখিয়ে অর্থ পরিশোধ করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ মানিলন্ডারিংয়ের বেশির ভাগ হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক যদি এটা বন্ধে সহযোগিতা না করে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহযোগিতা করে তাহলে আগেই পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। অর্থপাচার বন্ধে ব্যাংকগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, আমদানি-রফতানির তথ্য যাচাই-বাছাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তদারকির কারণে মানিলন্ডারিং কমছে। তবে অর্থপাচার বন্ধে ব্যাংকগুলোর বড় ভূমিকা থাকে। তারা প্রতিটি এলসি যাচাই-বাছাই করলে, তথ্য দিলে অনেকাংশেই বন্ধ হবে।

এ পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া কত টাকা ফেরত এসেছে এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, মানিলন্ডারিং একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম। এখানে বহু পক্ষ, বহু দেশ জড়িত। আমার দেশের আইনের মতো আরেক দেশের আইন এক নয়। এখানে কিছু আছে সিভিল ল’ কান্ট্রির দেশ, কিছু কমন ল’ কান্ট্রির দেশ। তবে একটা উদাহরণ আমাদের কাছে আছে, সিঙ্গাপুরে যে একটা টাকা পাচার হয়েছিল, ২০ লাখ ৪১ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার, সেটা ফেরত এনেছি।

বিএফআইইউ প্রতি বছর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ বছরের প্রতিবেদনে আগের বছরের মতো বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি হুন্ডি, অবৈধ গেমিং/ বেটিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং ও ফরেক্স ট্রেডিং প্রতিরোধে বিএফআইইউ কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের বিষয়ে পৃথক অধ্যায় সংযোজন এবং একাধিক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মাসুদ বিশ্বাস জানান, বিএফআইইউ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩৩টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থায় প্রেরণ করেছে, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৫৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া আলোচিত সময়ে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারি অন্য সংস্থার সাথে এক হাজার ৭১টি তথ্য বিনিময় করেছে, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। বিগত অর্থবছরে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদারকরণের ফলে বাংলাদেশ পাঁচটি দেশকে পেছনে ফেলে র‌্যাংকিংয়ে বিগত বছরের ৪১ নম্বর দেশ থেকে ৪৬ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/815736