২৯ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০৬

শিক্ষা ক্যাডারে বঞ্চনাই নিয়তি

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বঞ্চনার গল্প অনেক পুরোনো। অন্যান্য ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দেওয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি দেওয়া হয় বিষয়ভিত্তিক। ফলে এখানে চাকরি জীবনে কনিষ্ঠরা অনায়াসেই জ্যেষ্ঠদের ডিঙিয়ে ওপরে চলে যান। বিভিন্ন ক্যাডারের সঙ্গে বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য রয়েছে। ফলে বিসিএসের সবচেয়ে বড় ক্যাডার হয়েও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির দিক থেকে তলানিতে রয়েছেন এই ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

বর্তমানে বিসিএসের ১৬তম ব্যাচ থেকে ৩৫তম ব্যাচ পর্যন্ত ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা সব যোগ্যতা অর্জন করেও বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির অপেক্ষায় দিন পার করছেন। এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি’ সম্প্রতি শিক্ষা সচিব সোলেমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তারা জানান, এ সময়ের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়া না হলে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

সমিতির মহাসচিব মো. শওকত হোসেন মোল্যা সমকালকে বলেন, শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির গতি খুবই শ্লথ। বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতির অপেক্ষায় দিন পার করছেন। তারা শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শূন্যপদে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবারের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়া না হলে আমরা কর্মসূচি দেব।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পদোন্নতির জন্য আপনারা সরকারকে আলটিমেটাম দিতে পারেন কিনা– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা কোনো আলটিমেটাম নয়, অনুরোধ। আমরা পেশাজীবী সংগঠন করি। পেশার স্বার্থে নিজেদের দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরাই আমাদের দায়িত্ব।

এই ক্যাডারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা বলছেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ হাজার কর্মকর্তা বর্তমান সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার দীর্ঘদিন ধরেই বৈষম্যের শিকার। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও প্রকট। তারা বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্যান্য ক্যাডারে যোগ্যতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছর নিয়মিত পদোন্নতি হতে দেখা যায়। অথচ সব যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হচ্ছে না। নিয়মিত পদোন্নতি না থাকায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা চাকরির সন্তুষ্টি হারাচ্ছেন, যা প্রকারান্তরে সামগ্রিক শিক্ষার ক্ষতি করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারে এই মুহূর্তে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ৩৫তম বিসিএস ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। এর সঙ্গে ৩৬তম ব্যাচ আগামী মাসে পদোন্নতিযোগ্য হবে, তাহলে এ সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়াবে। প্রভাষক পর্যায়ে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা টানা ৯ থেকে ১১ বছর পদোন্নতির জন্য অপেক্ষায় আছেন।

আর সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতিযোগ্য ৩ হাজার শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার জন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন পদোন্নতি আটকে থাকায় বেশির ভাগ কর্মকর্তার মূল বেতন তাদের পদোন্নতি প্রত্যাশিত পদের সমান বা বেশি হয়ে গেছে। তাই পদোন্নতি দিলেও তাতে সরকারের ব্যয় তেমন বাড়বে না। ফলে বেশির ভাগ কর্মকর্তার পদোন্নতিতে তেমন কোনো আর্থিক সংশ্লেষ নেই। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন ৬৮৮ জন। পদোন্নতির জন্য ওই সব পদ শূন্য বিবেচনায় নিয়ে, প্রশাসনিক পদ ও ১০% রিজার্ভ পদ শূন্য বিবেচনা করলে মাউশি প্রস্তাবিত সব কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব।

তারা বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি প্রদানের নজির আছে। সেখানে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। ক্যাডার পদে পদোন্নতির জন্য শূন্য পদ থাকতে হবে এমন কোনো বিধান নেই।
রাজধানীর ঢাকা কলেজের একজন প্রভাষক বলেন, বেসরকারি কলেজে একজন শিক্ষক তার চাকরির ৮ বছরে ৫০% সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে থকেন, সেখানে শূন্য পদ বিবেচনার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা শূন্য পদের অজুহাতে ১০ থেকে ১২ বছরেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এটা কোনোক্রমেই যৌক্তিক হতে পারে না।

কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন শিক্ষা ক্যাডারের পদ সৃষ্টি না হওয়ায় পদোন্নতি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের জন্য প্রায় ১২ হাজার ৪৪৪ পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলমান। পদোন্নতিযোগ্য সব কর্মকর্তার পদোন্নতি দিয়ে নতুন সৃষ্টি হওয়া পদের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব বলেন, আগের তুলনায় বর্তমানে প্রতিষ্ঠান যেমন কয়েক গুণ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, সিলেবাস ও কোর্স বেড়েছে কয়েক গুণ। অথচ সে তুলনায় শিক্ষক পদ সৃজন হয়নি। বর্তমানে দেশের সরকারি কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা (অনার্স-মাস্টার্স) পর্যায়ে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে আদর্শ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪০ হলে সরকারি কলেজগুলোতে মোট শিক্ষক দরকার ১ লাখ ২৫ হাজার। সেখানে বর্তমানে সরকারি কলেজে শিক্ষক আছেন ১৬ হাজার। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সেক্টরে মাত্র ১২ হাজার ৪৪৪টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব তাও আটকে আছে ৮ বছর ধরে।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের ব্যাচভিত্তিক কমিটি রয়েছে। ২৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সভাপতি সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান লিখন বলেন, পদ সৃষ্টি না হওয়ায় এ ক্যাডারে পদোন্নতির গতি খুব শ্লথ। ওপরের দিকে পদ স্বল্পতার অজুহাতে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে শিক্ষা ক্যাডারের হাজার হাজার কর্মকর্তাকে। অথচ প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার ১৬তম ব্যাচের মহাসচিব ড. রেহেনা খাতুন বলেন, আগে শিক্ষা ক্যাডারে তিন স্তরে একসঙ্গে পদোন্নতি দেওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে প্রতিটি স্তরে আলাদা করে পদোন্নতি হয়। এতে পদোন্নতিতে আরও বেশি সময় লাগছে। তিনি বলেন, একজন পূর্ণ অধ্যাপকের বেতন গ্রেড বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে তৃতীয়, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে সেটি চতুর্থ। এখানেও বৈষম্য। কলেজের অধ্যক্ষ পদে পদায়ন কিংবা মাউশি, নায়েমসহ সব অধিদপ্তরে পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা মানা হচ্ছে না।

জানা গেছে, পদোন্নতি ছাড়াও শিক্ষা ক্যাডারে নিয়মিত বদলি নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কেউ কেউ রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে চাকরি করছেন যুগ যুগ, আবার কেউ মফস্বলেই পড়ে আছেন। নীতিমালায় তিন বছর পরপর বদলির কথা বলা হলেও, এর প্রয়োগ ততটা চোখে পড়ে না। বরং অভিযোগই বেশি শোনা যায়।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ২৫তম ব্যাচের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের বলেন, পদে পদে বঞ্চিত শিক্ষা ক্যাডারের বঞ্চনা হ্রাসে সরকার বেশ কিছু পরামর্শ বিবেচনায় নিতে পারে।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ২৮তম ব্যাচের সাধারণ সম্পাদক মো. তানভীর হাসান বলেন, আমাদের ওপরের পদে যাওয়ার কোনো সোপান নাই। প্রথম, দ্বিতীয় গ্রেডে কোনো পদ নেই। এতে কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যায়।

অর্জিত ছুটি পান না
শিক্ষা বিভাগে সরকারিভাবে ‘ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সরকারি কলেজে সরাসরি শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত রয়েছেন, তারা অর্জিত ছুটির আর্থিক সুবিধা থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন।

বেতন বৈষম্য ও ওপরে যাওয়ার সুযোগ কম
প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে যান। অথচ শিক্ষা ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তারা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে জাতীয় বেতন স্কেলের চতুর্থ গ্রেডে যান। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে অষ্টম জাতীয় স্কেল কার্যকরের আগে চতুর্থ গ্রেড পাওয়া শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা সিলেকশন গ্রেড পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে যেতে পারতেন। সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় তাদের সেই পথও এখন রুদ্ধ। বেতন বৈষম্য নিরসনে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে সে সময় গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটি এই ক্যাডারে সিলেকশন গ্রেড দিতে রাজি হলেও অদ্যাবধি তা কার্যকর হয়নি। এই ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। পদটি দ্বিতীয় গ্রেডের। প্রধানমন্ত্রী এ পদটিকে প্রথম গ্রেডে উন্নীতের সিদ্ধান্ত দিলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। এ ছাড়া অধ্যাপক পদে কর্মরতদের শতভাগ তৃতীয় গ্রেডে যাওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তও থমকে আছে। এই ক্যাডারে দ্বিতীয় গ্রেডে আরও সাতটি পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন।
অন্যান্য বঞ্চনা

নিজ ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে থাকলেও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের জন্য কোনো যানবাহন নেই। অথচ বেতন স্কেলে অনেক পেছনে থাকা বিভিন্ন ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। রাজধানীর ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আসলে শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ যে একটি বিনিয়োগ, তা মাথায় রাখা দরকার। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করলে চাইলে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষা পরিবেশ জরুরি। শিক্ষা ক্যাডারকে বঞ্চনায় রেখে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সুদূর পরাহত।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

শিক্ষা ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, নতুন পদ সৃষ্টির জন্য আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও জনপ্রশাসন, অর্থ মন্ত্রণালয় ঘুরে এই সিদ্ধান্ত হতে প্রক্রিয়াগত কারণে কিছুটা সময় লাগছে। নতুন পদ সৃষ্টি হলে এ ক্যাডারের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2308192697