২৯ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০৪

দোতলা, তিনতলা যানজট, ভোগান্তি

যানজটের চিরচেনা রূপ ধরে রেখেছে রাজধানী ঢাকা। অথচ যানজট থেকে মুক্তি পেতে রাজধানীতে করা হয়েছে একাধিক ফ্লাইওভার। দু’তলা, তিনতলা এসব ফ্লাইওভার যানজটমুক্ত করতে পারেনি। বরং দিনের বেশির ভাগ সময় ফ্লাইওভার তার ঘাড়ে যানজট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর নিচের রাস্তার যানজট তো নিয়মে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নিচ থেকে মানুষ দু’তলা, তিনতলা যানজটের চিত্র দেখে ফটো তুলে। এও যেন এক বিনোদন তাদের কাছে। অথচ যানজট কমাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকায় একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভার নির্মাণ করে বিশ্বের কোনো দেশ যানজট কমাতে পারেনি। তাই শহরের ভেতর আকাশ ঢেকে দিয়ে ফ্লাইওভার করা যানজটের সমাধান নয়।

ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ ও মানসম্মত গণপরিবহনের মান উন্নয়ন করতে পারলে যানজট কমবে।
ঢাকার ভেতরে যানজটের জন্য বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। এরমধ্যে অন্যতম মগবাজার, মহাখালী ও মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। এই তিনটি ফ্লাইওভারে যানজট নিয়মিত চিত্র। মাঝেমধ্যে খিলগাঁও ফ্লাইওভারেও যানজট দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ফ্লাইওভারগুলো ‘সাপ্লাই সাইড ম্যানেজমেন্ট’ এর কাজ করে। এতে যানবাহনের জন্য সড়কের সাপ্লাই দেয়া হয়। তবে এই ধরনের ফ্লাইওভার যানজট কমাতে পারে না। এর বিকল্প ফ্লাইওভার হলো কুড়িলে। তাই যানজট কমাতে কুড়িল ফ্লাইওভার কার্যকর বলেও উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।

এক যুগের অধিক সময় ধরে সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী ট্রাফিক সার্জেন্ট হারুন অর রশিদ। মগবাজার পুলিশ বক্সে আলাপ হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকে। ব্যক্তিগত গাড়িতে করে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাতায়াত করে। একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি গাড়ি অন্য একটি ছোট বাসের অর্ধেক রাস্তা দখল করে। আবার এসব গাড়ি স্কুলের আশেপাশের সড়কে অবস্থান নিয়ে রাস্তা দখল করে। ফলে অফিসের সময় ছাড়াও সারাদিনই সড়কে যানজট থাকে। তিনি বলেন, ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল বাসে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত করানো হলে গাড়ির চাপ অনেক কমে যেতো। সড়কে যানজটও অনেক কমতো। বাংলামোটরে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মাসুদ রানাও ওই এলাকার সপ্তাহব্যাপী যানজটের চিত্র তুলে ধরেন। জানান, বাংলামোটরে সবচেয়ে বেশি যানজট থাকে সপ্তাহের বুধবারে। এই যানজট এতই বেশি হয় যে, তা বাংলামোটর সিগন্যাল থেকে মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে চলে যায়। আর ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে তা মৌচাক পর্যন্ত চলে যায়। অবশ্য এজন্য কাওরান বাজার মোড়ের সিগন্যালে গাড়ি আটকে থাকাকে দায়ী করেন তিনি। এ ছাড়া বাংলামোটর থেকে শাহবাগের সড়কেও যানজট লাগে বলেও জানান তিনি। মাসুদ রানা বলেন, দিনের শুরুতে সকাল সাড়ে ৭টার পর থেকেই যানজট শুরু হয়। এরপর তা বাড়তে থাকে। সাড়ে ১০টা পর্যন্ত গাড়ির অনেক চাপ থাকে। পরে এক ঘণ্টা কিছুটা যানজট কমে। ফের সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গাড়ির চাপ বাড়ে। আবার বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গাড়ির চাপ বাড়ে। শুক্রবার বিকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্তও কিছুটা যানজট থাকে বলেও জানান এই ট্রাফিক সার্জেন্ট।
মগবাজার-বাংলামোটর সড়কে নিয়মিত রিকশা চালান মো. জলিল। তিনি বলেন, এখানে সবসময় যানজট লাগে। ফ্লাইওভারের উপরেও গাড়ি আটকে থাকে। আমার রিকশা নিয়ে ৩০-৪০ মিনিট লাগে এই সিগন্যাল পার হতে। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই যানজটে পড়তে হয়। ওই রুটের এম এম লাভলী বাসের এক চালক বলেন, মৌচাক থেকে যানজট শুরু হয়। মগবাজার পর্যন্ত একই অবস্থা। অনেক সময় আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে নিয়ে যাই তখনও বাংলামোটরের আগে ফ্লাইওভারের উপরে যানজটে পড়ি। অনেক সময় লেগে যায় এই রাস্তায়।

ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে টোল দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। এতেও যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানে ফ্লাইওভার দিয়ে গেলে গুলিস্তানের পয়েন্টেই টোল নেয়া হয়। সেখান থেকেই যানজট শুরু হয়। তাছাড়া ফ্লাইওভার থেকে নামার পরও চৌরাস্তার সিগন্যালে আটকে থাকাও দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয় যা ফ্লাইওভারে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের মুখে যাত্রী ওঠানামা করানোর কারণেও যানজট সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ যানজটের কারণে কখনো কখনো যাত্রীদের হেঁটে ফ্লাইওভার থেকে নামতে দেখা যায়। শ্রাবণ ট্রান্সপোর্টের এক চালক বলেন, ফ্লাইওভারের মুখেই যানজট শুরু হয়। যখন গাড়ির চাপ বেশি থাকে তখন অনেক দূর পর্যন্ত যানজট থাকে। হানিফ ফ্লাইওভারের গোলাপবাগ অংশে মুগদামুখী গাড়িগুলো নামে। এখানে মাঝেমধ্যে যানজটে আটকে থাকতে হয় গাড়িগুলোকে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের শহরের ভেতরের ফ্লাইওভারগুলোর ‘সাপ্লাই সাইড ম্যানেজমেন্ট’ করে। এতে ট্রান্সপোর্টের সাপ্লাই হিসেবে রোডের সাপ্লাই দেয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো শহর শুধুমাত্র সাপ্লাই দিয়ে যানজট কমাতে পারেনি। ফ্লাইওভার যানজট কমায় না। অধিকাংশ দেশের জন্য ফ্লাইওভার একটা বাতিল ধারণা। বরং ‘প্রাইভেটকার ম্যানেজমেন্ট’র দিকে বিশ্ব এগিয়েছে। গণপরিবহন বাড়ানো, শহরের ভেতর মানসম্মত রেল, বিআরটি সার্ভিস, এমআরটি দিয়ে শহরের যানজট কমিয়েছে। প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ করে যানজট কমানোর মূল মন্ত্র। তিনি বলেন, কুড়িল ফ্লাইওভার হলো ‘ইন্টারচেইন ফ্লাইওভার’। এই ফ্লাইওভারে বিভিন্ন দিকে গতিপথ চেঞ্জ করে দিবে। এটা শহরে কাজে লাগে। যানজট হয় না। তাই কুড়িল ফ্লাইওভার কার্যকরী। কিন্তু মগবাজারের ফ্লাইওভার ডিমান্ড বেজ ফ্লাইওভার। এটাতে রাস্তার সাপ্লাই বাড়ানো হয়েছে। এই ধরনের ফ্লাইওভার শহরে কোনো কাজ করে না। মহাখালী ফ্লাইওভারও একই ধরনের। তাই সেখানে যানজট হয়।

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশ্ব যেখানে ফ্লাইওভারকে পরিত্যাগ করেছে আমরা সেখানে গত ১০ বছরে ফ্লাইওভারকে আঁকড়ে ধরেছি। এটা ভুল ট্রান্সপোর্ট পলিসি। কিন্তু ইন্টারচেঞ্জ ফ্লাইওভার আমাদের দরকার আছে। কুড়িল, হানিফ ফ্লাইওভারের মতো। তবে হানিফ ফ্লাইওভারেও কিছু সাপ্লাই সাইডও রয়েছে। এটাকে দীর্ঘ করে সাপ্লাই সাইড করেছে। এসব ফ্লাইওভারের কারণে নতুন করে এন্ট্রি পয়েন্ট, এক্সিট পয়েন্ট সৃষ্টি করে। সেই পয়েন্টগুলোতে যানজট তৈরি হচ্ছে।

এদিকে গত বছর ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) জানিয়েছে, ঢাকায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। প্রতিদিন যোগ হচ্ছে প্রায় ৪০টি নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি। এ ছাড়া বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যাও। ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে রাজধানীতে বাড়ছে যানজট-বিশৃঙ্খলা। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে যানবাহনের গতিবেগ কমায় প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে। বছরে রাজধানীর যানজটের কারণে ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলেও ওই গবেষণায় উঠে এসেছে। বছরে যানজটের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ।

https://mzamin.com/news.php?news=71457