২৯ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৯:৫২

জামায়াতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও দুর্গম পথে তার অগ্রযাত্রা

-ড. মো. নূরুল আমিন

॥ এক ॥
গত ২৬শে আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর ৮২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। সাধারণত জামায়াত বা জামায়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ জন্মবার্ষিকী বা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেন না; কিন্তু এবার কয়েকটি কারণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন নয় বরং এই ৮২ বছরে জামায়াতের উত্থান পতন, অর্জন সাফল্য ব্যর্থতা, সরকারি ও বেসরকারি নির্যাতন ও প্রতিরোধ মোকাবিলায় তার সামর্থ এবং বিশেষ করে মহান আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে জামায়াতের ঈর্ষণীয় অবস্থান অর্জন তাকে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। জামায়াতেহর এই অবস্থান বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত নোটিশে ঢাকা মহানগরীতে লক্ষ লক্ষ লোকের শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাবেশ অনুষ্ঠান, বিভাগীয় শহর ও জেলাসমূহে বিশাল বিশাল সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন দেখে দেশ বিদেশের মানুষ কেউ হতভম্ভ ও বিস্মিত হয়েছেন, আবার কেউ আতঙ্কিতও হয়েছেন।

সাম্প্রতিক অতীতে যেখানে দেশী বিদেশী টির্ভি চ্যানেল ও প্রচার মাধ্যমসমূহে টকশো এবং সাক্ষাৎকারে জামায়াত অবজ্ঞার পাত্র ছিল এখন আর তা নেই। যে স্বৈরাচারী জালেম সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পর আল্লামা সাঈদীসহ শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতাদের পরামর্শ দেন যে, তারা যেন তাদের ক্ষমতার মেয়াদে হয় দেশের বাইরে চলে যান কিংবা দেশের ভেতরে থাকলেও সরকারের সমালোচনা কিংবা সরকার বিরোধী জনমত গঠনের কাজে অংশ না নেন। ভারতকে ট্রানজিট করিডোর, বন্দর গ্যাসসহ সড়ক ও রেল পরিবহন সুবিধাবলী দেয়ার ব্যাপারে তারা যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক তৈরি করার পরিকল্পনা করছিলেন সেগুলো যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্যই তারা জামায়াত নেতাদের সাথে এই বুঝাপড়ায় আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হন। পরে ভারতীয় পরামর্শে এই সরকার ১৯৭২ সালে ত্রিদেশীয় চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক ক্ষমাপ্রাপ্ত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ টাইব্যুনাল আইনে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে মিথ্যা মামলা ও সাক্ষ্য প্রমাণ সাজিয়ে বিচারের নাটক করা হয় এবং তাদের ফাঁসি দেয়া হয়। একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সহায়তায় ক্ষমতায় আরোহণ ও টিকে থাকার জন্য তাদেরকে ভূখ- ব্যবহার, সমুদ্র ও নদীবন্দর ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সুবিধা প্রদান এবং তাতে জনগণ যাতে বাধা প্রদান করতে না পারে সে জন্য মিথ্যা অভিযোগে নিজ দেশের প্রতিভাবান আলেম ওলামা ও রাজনৈতিক নেতাদের জুডিসিয়াল কিলিং এর নজীর দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। এই সত্যটি শেখ হাসিনা নিজেই প্রকাশ করেছিলেন। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে, তৎকালীন মার্কিণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপের ট্রান্সক্রিপ্ট যুদ্ধাপরাধ মামলাসমূহের প্রাথমিক পর্যায়ে পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। হিলারী ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তার সরকার কর্তৃক সূচিত যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতীয় দূত তাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিবেন। কেননা ভারতীয় অনুরোধে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা হয়েছে। তার এই জবাবটি বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারত জামায়াতকে ভয় করে। তারা মনে করে জামায়াত শক্তিশালী হলে বাংলাদেশ থেকে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে এবং দেশটির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালাকে তাদের অনুকূলে যেভাবে প্রভাবিত করতে পারছে তা আর পারবে না। সম্প্রতি গত ১৯ শে আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোতে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি নোট (নোট ভার্বাল) পাঠিয়েছে। এতে জামায়াতকে ধর্মান্ধ মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যায়িত করে বলেছে যে, এই সংস্থাটি শক্তিশালী হলে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। কূটনৈতিক নোটে ভারত আরো উষ্মা প্রকাশ করে বলেছে যে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার ও দল দুর্বল হলে জামায়াত শক্তিশালী হবে এবং তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হবে। ছোট একটি দল জামায়াতকে তারা এতই ভয় করে!

বাংলাদেশে জামায়াতের ন্যায় নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত আর কোনও দল আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী সকল দলের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার হরণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে জামায়াত নেতাকর্মীদের উপর নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে। তাদের রাস্তাঘাটে ধরে হত্যা করা হয়। তাদের সম্পত্তি, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দখল করে নেয়। পাকিস্তানী দালাল ও রাজাকার আখ্যায়িত করে লক্ষাধিক জামায়াত নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়। তাদের দাফন করতেও দেয়া হয়নি। আমার গ্রামের বাড়ির অদূরে দাগনভূইঞা উপজেলার ক্রোশমুন্সির হাটের দক্ষিণ পশ্চিম মাথায় ব্রাশ ফায়ার করে ১৪ ব্যক্তিকে হত্যা করে একই গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়। একইভাবে ফেনীর রাজার ঝির দিঘীর উত্তর পূর্ব পাড়েও ৩২ ব্যক্তিকে হত্যা করে একই গর্তে তারা মাটি চাপা দিয়েছিল। এদের মধ্যে উর্দুভাষী মুসলিমও ছিল। সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় এ ধরনের হাজার হাজার নজির রয়েছে। তখন জামায়াতের কোনও নেতাকে কাজ কর্ম করতে দেয়া হয়নি। কিন্তু জামায়াতের কাজ কর্ম বাস্তবে একদিনের জন্যও বন্ধ ছিল না। জামায়াতের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে, ১৯৭২ সালের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতেও কয়েকজন দুঃসাহসী তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জামায়াতের দাওয়াতি কাজ, নির্যাতিত জামায়াত কর্মীদের খোঁজ খবর নেয়াসহ দুর্গত পরিবারসমূহের পুনর্বাসনের ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকা শহরের এক সময়ে আমীর হাফেজ মাওলানা নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে তাঁতীবাজারের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে একটি মেস ও অস্থায়ী অফিস স্থাপন করে এই কাজটি শুরু করা হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে ঐ তরুণ দলের সাথে কাজ করার আমারও সুযোগ হয়েছিল। এক্ষেত্রে সাপ্তাহিক জাহানে নও-এর সম্পাদক মাওলানা আবদুর রহীম সাহেবের জামাতা হাফেজ হাবিবুর রহমানের অবদানও ছিল প্রশংসনীয়। ঐ সময় সাপ্তাহিক সোনার বাংলাও জামায়াত কর্মী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাঙ্গা রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এই উদ্যোগী দাঈদের মধ্যে জনাব আলতাফ হোসেন (বর্তমান মফস্বল সাংবাদিক সমিতির সভাপতি), জনাব মাহবুবুল হক (বর্তমানে সিএনসির নির্বাহী কর্মকর্তা), ঢাকা ডাইজেস্টের সম্পাদক অধ্যাপক ফজলে আজীম (মরহুম) এবং দৈনিক সংগ্রামের ফটোগ্রাফার মরহুম সেলিমের নাম উল্লেখ করতে হয়। তাঁতী বাজারের অফিস পরিচালনা ও সেখানে দাওয়াতী কাজে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ঐ অফিস ও মেস বাড়িটি পরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাংলামটরে স্থাপিত সেলিম সাহেবের শাপলা স্টুডিও তার স্থলাভিষিক্ত হয়। এখানে নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠক অনুষ্ঠান ছাড়াও সারাদেশের সাংগঠনিক ভাইদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং ক্ষয়ক্ষতির নির্ণয়ের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা ও মনিটরিং এর কাজ করা হতো। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে মাওলানা আবু তাহের মরহুম এই টীমের সাথে যোগ দেন। দেশের প্রত্যেকটি জেলা ও থানা সফর করে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের পরিবারের অবস্থা নির্ণয় করে সম্ভাব্য সহযোগিতার ধরন প্রকৃতি নির্ণয়ের ভার তার উপর অর্পিত হয়েছিল এবং তিনি যথাযথভাবে তা পালন করেছিলেন। এই কথাগুলো আমি এখানে এজন্য আনছি যে, একাত্তর পরবর্তী বিধ্বস্ত জামায়াতের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের ইতিহাস অনেকেই জানেন না এবং জামায়াতের উপর যে কয়টি ইতিহাস বই লেখা হয়েছে তার মধ্যেও এগুলো নেই।

অনেকে জামায়াতের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমার মতে জামায়াতের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ইসলামকে নিছক ধর্মের স্থলে একটি কালজয়ী জীবন ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন ও এই জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠার জন্য কোটি কোটি মানুষের মন মানসিকতায় অনুকূল পরিবর্তন সাধন। এসব লোক এই জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন ও সম্পত্তি উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তার দ্বিতীয় অর্জণ বিশাল একটি সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি, যা আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সক্ষম। তার তৃতীয় সাফল্য হচ্ছে ইসলাম যে রাজনীতি বর্জিত কোন দ্বীন নয় তা প্রমাণ করা। নব্বই-এর দশক পর্যন্ত আমাদের দেশের বেশির ভাগ আলেম ইসলামে রাজনীতি হারাম বলে ফতোয়া দিতেন। এসব আলেমরাই পরে রাজনীতিকে ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সমাজ পরিবর্তনে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। এটা জামায়াতের সাফল্য। জামায়াতের চতুর্থ সাফল্য হচ্ছে সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত ছাত্র সমাজকে ইসলামের পথে আনা ও তাদের মধ্যে সমৃদ্ধ ইসলামী পন্ডিত তৈরি করা। তার পঞ্চম সাফল্য হচ্ছে এই যে, ক্ষমতায় গিয়েও সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে এবং স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে যে মন্ত্রীত্ব করা যায় তা প্রমাণ করা। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশোতে একজন আলোচক মন্তব্য করেছেন যে, আগামী একশ’ বছরেও জামায়াত ক্ষমতায় আসতে পারবে না। জামায়াত ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনও দল নয়, ক্ষমতায় গিয়ে অবৈধভাবে নিজে টু পাইস কামানো ও অন্যদের কামানোর সুুবিধা দেয়া তার লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য আল্লাহর অনুশাসন মেনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই লক্ষ্যে তারা কতটুকু পৌঁছতে পেরেছে তার মূল্যায়ন খুবই কঠিন। তবে সংখ্যাতাত্বিক সাফল্য বিবেচনা করলে বুঝা যায় যে, তারা আল্লাহর রহমত থেকে কখনো বঞ্চিত হননি, শত নিপীড়ন সত্ত্বেও। উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও মন্তব্যের পর আমি জামায়াতের আট দশকের কর্মকান্ড নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করবো। এখানে একটা কথা বলে রাখি যে, জামায়াতের প্রতিষ্ঠা ১৯৪১ সালে বৃটিশ আমলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালে দলটির কাজকর্ম ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশ হবার পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নতুনভাবে নতুন কাঠামো নিয়ে কাজ শুরু করে। এর সাথে আগের কোন ধারাবাহিকতা নেই। এখন মূল আলোচনায় আসি।

গত শতাব্দীতে উপমহাদশের মুসলমানরা যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব প্ররোচনায় বিভ্রান্ত এবং নানা দল উপদলে বিভক্ত, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, আলেম সমাজের মধ্যে বিভিন্ন বিতর্ক সাধারণ মানুষকে শরয়ী বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছিল তখন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদগ্ধ আলেম ও প-িত, খ্যাতনামা লেখক ও সাংবাদিক এবং যুগশেষ্ঠ দাঈ ও সংগঠক সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী ১৯৪১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাঞ্জাবের লাহোরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মুসলিম জাতির বিশেষ করে উপমহাদেশের মুসলমানদের মুক্তির পথ অন্বো এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত উলামায়ে কেরামদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ৭৫ জন খ্যাতনামা আলেম-ওলেমা ইসলামী চিন্তাবিদ অংশ গ্রহণ করেন। তারা মাওলানা মওদুদী (র) সম্পাদিত উন্নত মানের বুদ্ধিবৃত্তিক সাময়িকী মাসিক তর্জুমানুল কুরআনের আবেদন বিশ্লেষণ এবং রাসুল (স) এর পদ্ধতি অনুসরণ করে ইসলামী আন্দোলনের তিনটি বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এগুলো বাস্তবায়নের উপর জোর দেন। তাদের দৃষ্টিতে কোনো আন্দোলনকে সত্যিকারের ইসলামী হবার জন্য এই তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এই উপদানগুলো হচ্ছে।

১। যে দেশ বা সমাজে ইসলামী হুকুমত বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেই অভীষ্ঠ দেশ বা সমাজের নির্দিষ্ট জনগণের মনোযোগ আকর্ষণকে সামনে রেখে ইসলামকে একটি বিপ্লবী আদর্শ হিসাবে প্রচার করতে হবে। বিপ্লব এবং বিজয়ের চেতনাই ইসলামি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা।
২। যারা এই বিপ্লবী আদর্শের দাওয়াত কবুল করতে প্রস্তুত হবেন তাদের সকলকে এই আদর্শের আলোকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তাদের মন, মানসিকতা, ধীশক্তি, মস্তিষ্কের অনুশীলন এবং চারিত্রিক কাঠামো সব কিছুই ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে।

৩। এভাবে শিক্ষাপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি সমাজ থেকে ইসলামবৈরী নেতৃত্ব পরির্তন করে ইসলামী নেতৃত্ব ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতি হবেন, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে যাদের চরিত্র ইসলামী বৈশিষ্ট্যম-িত এবং যারা ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে ইসলামকে অনুশীলন করেন তারাই শুধু সমাজে, ইসলাম কায়েম করতে সক্ষম। যাদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান ও তার চর্চা নেই তাদের দ্বারা সমাজে ইসলাম কায়েম হতে পারে না। লাহোর কনভেনশনে অংশ গ্রহণকারী উলেমা বুদ্ধিজীবীরা উপরোক্ত তিনটি কর্মপন্থাজনিত বৈশিষ্ট্যে একমত হন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য জামায়াতে ইসলামী করেন।
জামায়াত গঠনের পর পরই এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য একটি সংবিধান বা গঠনতন্ত্র গৃহিত হয়।
বৃটিশ আমলে (১৯৪১-৪৭) জামায়াতের যাবতীয় কর্মকান্ড নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে ঘিরে পরিচালিত হয়:

১। সমাজ সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন পুস্তক রচনার লক্ষ্যে ইসলামী গবেষণা কর্ম পরিচালনা করা। যাতে করে শিক্ষিত মুসলমানরা আধুনিক সমাজে মানুষের সমস্যাবলীর ইসলামী সমাধানের লক্ষ্যে সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারেন।

২। বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব ও সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর লোকদের নিষ্ক্রিয়তা ও স্থবিরাবস্থা দূর করার লক্ষ্যে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার এবং ইসলামী জ্ঞানের বিচ্ছুরণ।

৩। সমাজের সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের সংগঠিত করে তাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যাতে একই চরিত্রের মধ্যে সততা, সংহতি, ঈমানদারী ও দক্ষতার সমাবেশ ঘটে। একইভাবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা যাতে ইসলামের কঠোর অনুসারী এবং ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের তীব্র সমালোচনাকারীতে পরিণত হয়ে ইসলামী আন্দোলনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হতে পারে তা নিশ্চিত করা।
জামায়াত এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই ঐ দলের চেয়ে অধিকতর ফলপ্রসূ নয় যে দল নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের উপর প্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপ করে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে ভারতে দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু হয় (১৯৪৭-১৯৬২)। এই সময় জামায়াত জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এই বিভক্তির মাধ্যমে বস্তুত সংগঠনটি স্বতন্ত্র চরিত্র, কর্মধারা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তাদের কর্মক্ষেত্রও ছিল আলাদা। (চলবে)

https://www.dailysangram.info/post/533939