২৮ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৫:৪৭

পারফম্যান্স চুক্তিতেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কমছে না খেলাপি ঋণ

ঋণের হিসাব নিয়েও একাধিক তথ্য

পারফরমেন্স চুক্তি করেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কমানো যাচ্ছে না খেলাপি ঋণ। উপরন্তু খেলাপি ঋণ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত খেলাপি ঋণের হিসাব নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। এক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে সাথে অন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান বিভিন্নভাবে দিচ্ছে। যেমন- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাথে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) ২০২৩ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ৫৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে।

অন্য দিকে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’-এর সাথে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের একই অর্থবছরের এপিএ-তে গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের স্থিতি ৫৮ হাজার ৪৬২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। দুই হিসাবের মধ্যে পার্থক্য ৪৫৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

এখানেই শেষ নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উল্লেখ করা হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে একই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উল্লেখ করা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর চূড়ান্ত মূল্যায়ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ২০২২ সালের জুন শেষে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি ৪৭ হাজার ৫৬২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এপিএতে গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রকৃত অর্জন হিসাবে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি ৫৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। দুই হিসাবের মধ্যে পার্থক্য ৮ হাজার ৩৫৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

একইভাবে খেলাপি ঋণের হারের হিসাবেও অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাথে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’-এর এপিএতে প্রারম্ভিক বক্তব্যে (পৃষ্ঠা-৩) ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। একই চুক্তির ৬নং পৃষ্ঠায় ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার ২৩ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে।

জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ ব্যাংকগুলোর সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ব্যাংকগুলোর সাথে পৃথক এপিএ (অ্যানুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্ট) সই করে আসছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন সূচকের পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ সন্তোষজনক পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এপিএ তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি বছর রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ৪৩ হাজার ৩৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ হাজার ৫৬২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের স্থিতি আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ৪৬২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের স্থিতি ৫৭ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। একই সাথে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। আগে এই পরিকল্পনার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২৫ সালের মধ্যে।
ব্যাংকগুলোর নিজস্ব প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ১১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা (এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২,১০০ কোটি টাকা)। জনতা ব্যাংকের ১৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা (গত বছর ছিল ১১,৯৯৮ কোটি টাকা); অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা (গত বছর ছিল ৯,৪৪৬ কোটি টাকা)। রূপালী ব্যাংকের ৯ হাজার ২২৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৬,৪৫৭.৭৭ কোটি টাকা)। বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৭,৬৩২.৪৭ কোটি টাকা) ও বিডিবিএলের খেলাপি ঋণের স্থিতি ১ হাজার ২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৭২৯.১২ কোটি টাকা) প্রাক্কলন করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/772829