২৮ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৫:২৬

ঘাতকও যখন ‘জাতীয় বীর’

আশিকুল হামিদ

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর দীর্ঘ ৭৫টি বছর পার হয়ে গেলেও ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও প্রমাণ করতে পারেনি যে, সাংবিধানিকভাবে ভারত সত্যিই একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র। বিশেষ করে নানা অজুহাতে মুসলিম হত্যাসহ ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর ব্যাপারে ভারত এখনও বিশ্বে ‘অতুলনীয়’ অবস্থানে রয়েছে।
এই সময়ের কথাই ধরা যাক। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্নাটকের স্কুল-কলেজগুলোতে মেয়েদের হিজাব ও বোরখা পরার বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধের স্টাইলে সশস্ত্র অভিযান চালাচ্ছে আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সন্ত্রাসীরা। এরা ক্ষমতাসীন বিজেপির ঘোষিত অনুসারী। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যখন ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেও পাল্টা প্রচারণায় নামতে হয়েছে। ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরো একবার দাঙ্গা বাঁধানোর এবং মুসলিমদের হত্যাকান্ডে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন।

উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রাজিব ও সোনিয়া গান্ধীর কন্যা এবং রাহুল গান্ধীর বোন প্রিয়াংকা গান্ধী বলেছেন, কর্ণাটকসহ বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার শস্তা কৌশল হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী মোদি মুসলিম বিরোধী রাজনীতি শুরু করেছেন। এজন্যই মেয়েদের স্কুল-কলেজে গেরুয়া পরা বহিরাগত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। তারা প্রকাশ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধরনের স্লোগান দিয়ে মিছিল করে বেড়াচ্ছে। এদের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই মুসকান খান নামের একজন মুসলিম ছাত্রী একাই ‘আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দিয়ে সমগ্র বিশ্বে ভাইরাল হয়েছেন। নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজায়ীসহ আরো অনেক বিখ্যাতজনই মুসকান খানের তথা মুসলিমদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। সোচ্চার হয়েছেন। বলেছেন, হিজাব বা বোরখা পরবে নাকি জিন্স পরবে সেটা সম্পূর্ণরূপেই মুসলিম ছাত্রীদের ইচ্ছার ব্যাপার। এখানে নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপি নেতাদের কিছুই বলার থাকতে পারে না।

অন্যদিকে শুধু পোশাকের ব্যাপারে নয়, খাদ্যসহ বিভিন্ন বিষয়েও হিন্দত্ববাদীরা নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে চলেছে। যেমন ভারতের মুসলিমরা যাতে তাদের প্রিয় স্বাস্থ্যকর খাদ্য গরুর গোশত খেতে না পারেন সেজন্য গরু জবাই করার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কারণ, গরু তাদের ‘গো-মাতা’! ভারতের অনেক রাজ্যেই মাইকে আযান দেয়া আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এমনকি কমিউনিস্ট নামধারী প্রগতিশীলরাও পিছিয়ে নেই। পশ্চিম বঙ্গে কমিউনিস্টদের অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই মাইকে আযান নিষিদ্ধ হয়েছে। আযানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বলা হয়েছে- আযানে ‘কমরেডদের’ নাকি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিরক্তি লাগে! এরকম শত শত উদাহরণ দেয়া সম্ভব, যেগুলো প্রমাণ করবে, ভারত আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। বিশেষ করে ইসলাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেশটিতে এখনও ভয়ংকরভাবেই চরমপন্থী কার্যকলাপ চলছে।

কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও আক্রান্ত হয়েছে। মাত্র বছর খানেক আগে, ২০২১ সালে সংস্থাটির বিরুদ্ধে আইনের আড়ালে হঠাৎ কঠোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েছিল বিজেপি সরকার। প্রধান একটি ব্যবস্থা হিসেবে সরকার সংস্থাটির সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল, যার ফলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে কোনো রকম আর্থিক লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। ভারতীয় গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি বাংলাদেশে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, অ্যামনেস্টির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে ভারত সরকার জানিয়েছে, সংস্থাটি নাকি বিদেশি সাহায্য বা তহবিল নেয়ার জন্য ভারতের ফরেইন কন্ট্রিবিউশন অ্যাক্টের আওতায় নিবন্ধন নেয়নি। অথচ যে কোনো বিদেশি সাহায্য বা তহবিল গ্রহণ করতে হলে সকল এনজিওকে ওই আইনে নিবন্ধিত হতে হয়। অন্যদিকে নিবন্ধন না নিয়েই অ্যামনেস্টি নাকি ইংল্যান্ড থেকে দু’দফায় ১০ কোটি এবং ২৬ কোটি পাউন্ড সাহায্য এনেছে! এ ব্যাপারে ২০১৭ সালে সরকার মামলা করলেও আদালতের রায় অ্যামনেস্টির পক্ষে গিয়েছিল। অ্যামনেস্টিও আগের মতো কার্যক্রম চালাতে শুরু করেছিল।

কিন্তু ২০২১ সালে হঠাৎ করেই ভারত সরকার আবার অ্যামনেস্টির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করেছে। এর ফলে থমকে গেছে সংস্থাটির গবেষণা ও প্রচারণাসহ সকল কার্যক্রম। অ্যামনেস্টির নির্বাহী পরিচালকসহ কর্মকর্তারা সে সময় বলেছিলেন, ভারত সরকার আসলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অলীক অভিযোগের ভিত্তিতে অ্যামনেস্টি এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনের বিরুদ্ধে ‘ডাইনি শিকারে’ নেমেছে। আর এর কারণ হলো, সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের রিপোর্টে দিল্লির দাঙ্গায় মানবাধিকার লংঘনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তাছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহারের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। এসব বিষয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল বিশেষ করে ভারতের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আর সেজন্যই ভারত সরকার আইনের আড়াল নিয়ে সংস্থাটিকে অচল ও বিপন্ন করার চেষ্টা চালাতে শুরু করেছিল। ভারতের অ্যামনেস্টি মনে করে, দিল্লির দাঙ্গা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার প্রশ্নে রিপোর্ট করাসহ প্রতিবাদী ভূমিকা পালনের কারণে সবই আসলে ছিল সরকারের পাল্টা ব্যবস্থা। আর সবকিছু চালানো হচ্ছিলও দু’ বছর ধরে। ক্রমাগত হয়রানি সত্ত্বেও ভারতের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অবশ্য তার ভূমিকা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। বলেছিল, নির্যাতিত মুসলিমসহ ভারতীয়দের মানবাধিকারের প্রশ্নেও তারা সোচ্চার থাকবে।

ঘটনাপ্রবাহে পরিষ্কার হয়েছিল, অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করাসহ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে ভারত সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সেগুলোর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ছিল দিল্লির দাঙ্গায় শত শত মুসলিম হত্যা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারণা চালানো। উল্লেখ্য, সেবারই প্রথম নয়, ২০১৭ সালেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার তদন্ত করে দেখেছে। সরকার অ্যামনেস্টির বিরুদ্ধে আইন লংঘনের অভিযোগে মামলাও দায়ের করেছিল। কিন্তু মামলায় জয়ী হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। অন্যদিকে আদালতের রায় অমান্য করে সরকার আবারও অ্যামনেস্টির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করেছে, যার ফলে সংস্থাটির পক্ষে বহুদিন পর্যন্ত স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়নি।

কথায় কথা বেড়ে যাওয়ার আগে এবার মূল বিষয়ের দিকে যাওয়া দরকার। বাংলাদেশে আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসেবে পালন করা হলেও ভারতে এতদিন অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত মাসটি উদযাপিত হয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের মাস হিসেবে। হঠাৎ ‘এতদিন’ বলায় পাঠকরা ধন্ধে পড়তে পারেন। কিন্তু কথাটা বলার পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। ভারতে ‘মহাত্মা’ নামে সম্মানিত হয়ে আসা নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে সে সময় খোদ ভারতেই চূড়ান্তভাবে অসম্মানিত করা হয়েছে। বড় কথা, অসম্মানিত করাও হয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। নাথুরাম গডসে নামের যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী মিস্টার গান্ধীকে সবার সামনে গুলি করে হত্যা করেছিল তাকেই ২০২১ সালে এসে বিজেপি সরকার ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। শুধু তা-ই নয়, নাথুরাম গডসে’র গান্ধী বিরোধী অভিযোগ এবং সম্পূর্ণ বক্তব্যকেও সরকার ‘ঐতিহাসিক সত্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যার অর্থ, পাকিস্তানের মুসলিমদের প্রতি ‘দরদ’ দেখানোর এবং আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে গান্ধী ভারতের হিন্দুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন! সে কারণে গান্ধীকে হত্যার সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ ‘সঠিক’ ছিল! একই কারণে গডসেকে ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা দরকার। গডসের অন্য সহযোগীরাও ‘জাতীয় বীর’ এবং গান্ধী নিজেই বরং ‘বিশ্বাসঘাতক’!

https://www.dailysangram.info/post/533837