২২ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:৩০

প্রিজন সেলে আল্লামা সাঈদীর মৃত্যু : কিছু কথা

ড. মো. নূরুল আমিন

বিশ্বনন্দিত আলেমেদ্বীন, খ্যাতানামা মুফাসসিরে কুরআন, জনপ্রিয় ও ক্যারিশম্যাটিক বক্তা এবং শতাব্দির অন্যতম ইসলামী দাঈ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গত ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪০ মিনিটে পিজি হাসপাতালের প্রিজনসেলে বন্দী অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় চুরাশি বছর। সরকার তাকে ১৯৭১ সালে কথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের ভিত্তিহীন মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড ও পরে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী বরেণ্য আলেম ছিলেন। মা ছিলেন গুলনাহার বেগম। আল্লামা সাঈদী চার পুত্রের গর্বিত পিতা ছিলেন। মরহুম রফিক সাঈদী, শামীম সাঈদী, মাসুদ সাঈদী ও নাসিম সাঈদী। তিনি তার পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে খুলনা আলিয়া মাদরাসায় কিছুকাল ও পরে ১৯৬২ সালে ছারসিনা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিলা পাস করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্র নীতি, মনোবিজ্ঞান ও বিভিন্ন তত্ত্বের ওপর দীর্ঘ পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি নিজেকে দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে উৎসর্গ করেন এবং পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশে আমন্ত্রিত হয়ে ইসলামের আদর্শ মানুষের কাছে তুলে ধরেন। বাংলাদেশে তার পরিচালিত তাফসিরুল কুরআন মাহফিল মুসলিম মানসে এক বৈপ্লবিক চেতনার সৃষ্টি করেছিল। তার মাহফিলে লক্ষ লক্ষ লোক তার সুললিত কণ্ঠে কুরআনের বাণী শোনার জন্য পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত। তার রুটিন মাহফিলগুলোর মধ্যে ছিল :
১. চট্টগ্রামের প্যারেড গ্রাউন্ডে বছরে ৫ দিন করে নিয়মিত মাহফিল। ২৯ বছর তিনি এই মাহফিলের মহানায়ক ছিলেক। পবিত্র কাবা শরীফের সম্মানিত ইমাম এই মাহফিলে দু’বার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
২. খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানসহ বিভিন্ন মাঠে তিনি প্রতি বছর ২ দিন করে ৩৮ বছর তাফসির করেছেন।
৩. সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে প্রতি বছর ৩ দিন করে টানা ৩৩ বছর তিনি মাহফিল করেছেন।
৪. রাজশাহী সরকারি মাদরাসা মাঠে প্রতি বছর তিন দিন করে একটানা ৩৫ বছর তিনি তাফসিরুল কুরআন মাহফিল পরিচালনা করেছেন।
৫. বগুড়া শহরে প্রতি বছর ২ দিন করে একটানা ২৫ বছর তিনি তাফসির করেছেন।
৬. ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে ময়দান ও পল্টন ময়দানে প্রতি বছর তিন দিন করে একটানা ৩৪ বছর তিনি কুরআনের তাফসির করেছেন। তার মাহফিলসমূহে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা থাকত।
আমাদের দেশে অতীতে ওয়াজ-মাহফিল যে হত না তা নয়। বরং অনেক বেশি হত। বিশেষ করে আমার জন্মস্থান বৃহত্তর নোয়াখালী,

চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে। এই তিনটি অঞ্চলের লোকজন তুলনামূলকভাবে ধার্মিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। মেয়েরা বেপর্দা অবস্থায় রাস্তায় খুব একটা বের হত না। আলেমদের সংখ্যাও কম ছিল না। জৌনপুরসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকার পীর সাহেবদের এসব অঞ্চলে বেশি আনাগোনা ছিল। এসব ওয়াজের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সেখানে বেহেশত-দোযখ নিয়ে বেশি আলোচনা হত। অল্প কিছু দোয়া-দরুদ আমল করে কিভাবে বেশি নেকি হাসিল করা যায় তার চর্চা খুব বেশি হত এবং বিবাহ-সাদী, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, তালাক-বিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও ফিকহি বিষয় নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রভৃতি আলোচনা, বিশ্লেষণ করে এক আলেম আরেক আলেমকে গালাগালি এমনকি কাফের ফতোয়া দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। লম্বা কুর্তা ও পাঁচ কল্লি টুপিওয়ালাদের ওহাবী আখ্যায়িত করে গালি-গালাজও কম হত না। ইসলাম যে জীবন ব্যবস্থা, তার রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর পরিষ্কার দিকনির্দেশনা আছে এই কথাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপরোক্ত ওয়াজ মাহফিলগুলোতে আলোচিত হত না এবং সমাজ সংস্কারের কোনো দিকনির্দেশনাও সেখানে পাওয়া যেত না। তথাপিও এই ওয়াজ মাহফিলগুলো থেকে যেকোনো উপকার পাওয়া যেত না তা নয়। আমি স্বয়ং ছোটকালে এসব মাহফিলে যোগদান করতাম, কখনো একা কখনো বাবার সাথে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মনের তৃপ্তি পেতাম না, জীবনাচারের কোনো দর্শন পেতাম না।

আল্লামা সাঈদীর তাফসির মাহফিলে আমি প্রথম যোগ দেই ১৯৭৯ সালে, নোয়াখালীর জেলা স্কুল মাঠে। নিতান্ত কৌতূহলবশত তখন আমি সরকারের পক্ষ থেকে ডানিডার প্রজেক্ট এডভাইজারি টিমে ডেপুটেশনে কাজ করতাম। মাহফিলের কথা শুনে গেলাম তামাশা দেখতে। ভাবলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ শুনে দেখি এই নতুন মাওলানা কী বলেন। নতুন বলছি এজন্য যে, তার নাম পাকিস্তান আমলে বা বাংলাদেশের প্রথম দিকে কখনো শুনিনি। জেলা স্কুল মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে প্রায় দশ মিনিট তার তাফসির শুনলাম। বিমোহিত হয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে শুনতে এসে না বসে পারলাম না। এই মৌলানা আলাদা মাওলানা। তার বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনা, গাম্ভীর্য, জ্ঞানের পরিসর, দরাজ কণ্ঠ, জীবন জিজ্ঞাসার সাথে বিষয়বস্তুর সম্পৃক্ততা এবং কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপের বর্ণনা, নবী-রাসূলদের (সা.) আগমনের উদ্দেশ্য, মুসলিম জাতির দায়িত্ব ও কর্তব্য, বর্তমান যুগের সমস্যাবলীর ইসলামী সমাধান, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামের অবদান এবং বর্তমান অনগ্রসরতা ও তার কারণ এবং প্রতিকার প্রভৃতি তার বক্তব্যকে আমার কাছে এতই আকর্ষণীয় করে তুলেছিল যে, মাঠের বিছানো তেরপালে বসে কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি তার বক্তব্য শুনেছি। শুধু কুরআন-হাদিস-ফিকাহ নয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর তার দখল দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। এরপর ১৯৮২ সালে চট্টগ্রামের প্যারেড গ্রাউন্ডে আমি তার মাহফিলের স্রোতা ছিলাম। উচ্চ শিক্ষা উপলক্ষে ১৯৮৩, ৮৪ ও ৮৫ সালে আমি ইংল্যান্ডে ছিলাম। সেখানে নরউইচ, লন্ডন ও স্কটল্যান্ডে আমার তার তাফসির মাহফিলে যোগদানের সোভাগ্য হয়েছিল। ইংরেজি ভাষার ওপর তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়। আমি নিজে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র ছিলাম। ইংল্যান্ডের বেল স্কুল অব ল্যাংগুয়েজ (Bell School of Language) এ ভাষা শেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আল্লামা সাঈদীর ইংরেজি ভাষার ওপর যে ব্যুৎপত্তি আমি দেখেছি তার কাছে তুচ্ছ। শুধু ইংরেজি নয়, তিনি একাধারে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি এবং ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। এই প্রতিভা ছিল তার আল্লাহ প্রদত্ত। বাংলায় তিনি তাফসির জগতের মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। তার তাফসির এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, বাসে, ট্রাকে, প্রাইভেটকারে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, বাসা-বাড়িতে মানুষ তার তাফসিরের রেকর্ড বাজিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং শেখাতেন। তার জনপ্রিয়তায় নাস্তিক, বাম, রাম ও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী ভীত হয়ে পড়ে এবং বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের ঘাড়ে চেপে তারা মাওলানা সাঈদীর মাহফিলের রেকর্ড বাজানোর ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শুধু তাই নয় তার তাফসির মাহফিলও বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে দৈনিক মানবজমিন ও ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রোব পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, সরকার নির্ধারিত কিছু জামায়াত নেতাদের সরকারের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব দেয় এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এই সরকারের মেয়াদকালে বিদেশে চলে যাবার অথবা দেশে থাকলে তাফসির মাহফিলসহ সকল প্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। জামায়াত ও আল্লামা সাঈদী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সরকারকে ভারত ট্রানজিট করিডোর, বন্দর, গ্যাস, কয়লাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে যে চুক্তি সম্পাদনের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তার বিরুদ্ধে যাতে জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলো প্রতিবাদ করতে না পারে এবং জনমত গঠন না হয় এ জন্যই তারা এই প্রস্তাব রেখেছিলেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় জামায়াতকে স্তব্ধ করা ও নেতৃত্বশূন্য করার জন্য ভারতীয় পরামর্শে তাদের বিরুদ্ধে পরে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে ফাঁসি ও অন্যান্য দণ্ড দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেলু রাজাকারের অপরাধ নির্দোষ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওপর আরোপ করে ক্যাঙ্গারু কোর্টে তার বিচারের নামে প্রহসনের নাটকের মাধ্যমে প্রথমে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও খুনের মিথ্যা অভিযোগ ছিল, যে মহিলাকে তিনি ধর্ষণ করেছেন বলে সরকার অভিযোগ এনেছিল সে মহিলা জীবিত থাকা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনাল তার সাক্ষী নেয়নি। আবার যে হিন্দু ভদ্রলোককে তিনি হত্যা করেছেন বলে সরকারের অভিযোগ ছিল, তার ভাই সুখরঞ্জন বালীকে সরকার বাদী হবার প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়ে রাজসাক্ষী বানিয়ে সেফ হোমে রেখে কীভাবে কি সাক্ষী দিতে হবে দীর্ঘদিন তার প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। সুখরঞ্জন বালী মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজি হননি। বিষয়টি টের পেরে তাকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে অপহরণ করা হয় এবং পরে ভারতের একটি জেলে তাকে আবিষ্কার করা হয়, আল্লামা সাঈদীর জানাযায় তিনি হাজির হন এবং একটি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেন এবং বলেন যে, মাওলানা সাঈদী নির্দোষ ছিলেন, তিনি রাজাকার ছিলেন না এবং তার ভাইকে তিনি হত্যা করেননি। মাওলানা তার এলাকায় দু’বার এমপি ছিলেন। এ সময় হিন্দুরা মায়ের কোলে যেমন নিরাপদ থাকে তেমন নিরাপদ ছিলেন। তার এই স্বীকৃতি কী প্রমাণ করে? মিথ্যা অভিযোগে তাকে যখন মৃত্যুদ- দেয়া হলো সারা দেশে লাখ লাখ লোক প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। সরকারের পুলিশ বাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলী করে দু’শতাধিক লোককে হত্যা করল। এ ধরনের জুলুম মানবেতিহাসে বিরল। যাই হোক, মৃত্যুদণ্ড পরে আমৃত্যু কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়। এই অবস্থাতেই অসুস্থ হবার পর তাকে প্রথমে গাজীপুরের তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে পিজি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাকে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠে এবং তিনি সেখানে মারা যান। তার অসুস্থতার কথা স্বজনদেরও জানানো হয়নি বলে জানা যায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার আমৃত্যু কারাজীবন এখানেই শেষ। কিন্তু তা কি শেষ হয়েছে। মৃত্যুর পরেও তার পুলিশ কাস্টডি শেষ হয়নি। তার মৃত্যুর খবর শুনে লাখ লাখ লোক পিজি হাসপাতাল ও তার আশপাশে ভিড় জমায়। তার জানাযায় অংশগ্রহণ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। পুলিশ জনতার চাহিদা অনুযায়ী ঢাকায় তার জানাযা অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। তাদের জিম্মায় তার লাশ পিরোজপুর নিয়ে যাওয়া হয়। তার অছিয়ত ছিল খুলনায় তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় তার লাশ দাফন করার এবং তার মেঝো ছেলে তার জানাযা পড়বেন। পুলিশ তার কোনো অছিয়তই রক্ষা করেনি। পিরোজপুরের সাঈদী ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পাসে তাকে দাফন করা হয়। লাখ লাখ লোক তথাপিও তাতে অংশ নিয়েছেন। মাওলানা সাঈদীর প্রতি এই অবজ্ঞা একজন বিজ্ঞ আলেমের প্রতিই শুধু অবজ্ঞা নয়, ইসলামের প্রতিও অবজ্ঞা। বাংলাদেশে এমন গুণী লোকের কদর নেই। সততা, নিষ্ঠা, পরহেজগারী এখন অপরাধ। চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, মানুষের সম্পদ লুট ও জবরদখল, ঘুষ রিসওয়াত, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, জ্বেনা, ব্যভিচার, জুয়া প্রভৃতি শাসকদের কাছে প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে স্বীকৃত। সাত খুনের মামলায় যাবজ্জীবন দ-িত আসামী দলীয় বিবেচনায় বছর না যেতেই সরকারের সুপারিশে রাষ্ট্রপতির অনুকম্পায় সদম্ভে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জনপদে শুধু ফিরেই আসে না, পুর্ণোদ্যমে পুরাতন অপরাধে লিপ্ত হতেও দেখা যায়। অন্যদিকে নিরপরাধ আলেম-ওলামা, সজ্জ্বন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ফরমায়েসী আদালতের রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন অথবা কারাগারের নির্মম প্রকোষ্ঠে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। এ দেশের মানুষের এখন এটাই নিয়তি।

উপরোক্ত অবস্থায় আমার প্রায়ই একটা ঘটনা মনে পড়ে। মাস আর তারিখ আমার মনে নেই, বছরটা মনে আছে। ১৯৬৩ সালে তমদ্দুন মজলিস বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের জিপিও সংলগ্ন পার্শ্বে দোতলায় ৩২ নং কক্ষে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মৃত্যুদিবস উপলক্ষে একটি স্মরণ সভার আয়োজন করেছিল। এতে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার মোস্তাফা কামাল। যিনি পরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তার সহকারী ছিলেন কবি ফারুক মাহমুদ। উক্ত স্মরণ সভায় আমি এবং মরহুম আব্দুল মান্নান তালিব উপস্থিত ছিলাম। অন্য যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবার নাম আমার মনে নেই। তবে এটা মনে আছে যে, উদ্যোক্তা শ্রোতা এবং প্রধান অতিথি সবাই মিলে আমরা মোট ১১ জন সেখানে ছিলাম। এই স্মরণ সভায় ড. মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ প্রধান অতিথি ছিলেন। বহুভাষাবিদ মুসলিম জাতির গর্ব এই পণ্ডিত স্মরণ সভার জনসমাবেশের অবস্থা দেখে হতবাক হলেন এবং ক্ষেপে গেলেন। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, মোস্তাফা কামাল তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এসে এই অপমানটা করলে। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এই উপমহাদেশের একজন বরেণ্য আলেম এবং মুসলমানদের সম্পদ ছিলেন। তার স্মরণ সভায় মুসলমানদের এই অনুপস্থিতিকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, যে দেশে ভালো মানুষের, জ্ঞানী ও গুণী মানুষের কদর নেই, সেই দেশে আল্লাহতায়ালা ভালো, জ্ঞানী ও গুণি মানুষ পয়দা করেন না। যেমন যে বাজারে ভালো পণ্যের কদর নেই, সেই বাজারে ভালো পণ্য উঠে না। আমরা জ্ঞাণী-গুণীদের কদর করি না। এ জন্যই মূর্খ বদমাসরা আমাদের মাথার উপর চেপে বসেছে। এর কি অবসান হবে না।
আল্লামা সাঈদী মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রিজন সেলে তার এই মৃত্যু শহিদী মৃত্যু হিসেবে আল্লাহ কবুল করুন এই দোয়া করে আলোচনা এখানেই শেষ করতে চাই।

https://www.dailysangram.info/post/533306