২২ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:২৮

পিয়াজে সেঞ্চুরি

গত কয়েক মাসে ৩ লাখ টন পিয়াজ দেশে আমদানি করা হয়েছে। তারপরও সরবরাহ ঘাটতি ও আমদানির খরচ বেশির অজুহাতে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া শনিবার পিয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। এ ঘোষণা আসার পরই বাংলাদেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে শুরু করে পিয়াজের দাম। একদিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা, যা আগের দিন ছিল ৮৫ টাকা। একইভাবে আমদানি করা পিয়াজ ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ রোববার কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ভারতের রপ্তানি মূল্য বাড়ানোর প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে না। আড়তদাররা জানান, ভারতের শুল্ক আরোপের পর থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাজার চড়া হচ্ছে। সকালে এক দাম আবার বিকালে আরেক দাম। সোমবার রাজধানীর কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে এ চিত্র দেখা গেছে।

এদিকে বাজারে যারা আগেই কিনেছিলেন সেসব কোনো কোনো দোকানে ৯০ টাকা কেজি দরে দেশি পিয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে।

গত সপ্তাহে ঢাকার বাজারে পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানগুলোতে দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮০ টাকায়। তার আগের সপ্তাহে এই পিয়াজের দাম ছিল ৬০-৬৫ টাকা। একইভাবে বেড়েছে আমদানি করে আনা পিয়াজের দাম।

টিসিবি’র হিসাবে সোমবার বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। এই পিয়াজ গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। আর আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। আর এই মানের পিয়াজ এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।

এদিকে হিলিতে শনিবার যে পিয়াজের পাইকারি বাজার ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা, সোমবার সেই পিয়াজ প্রকারভেদে পাইকারদের নিতে হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে। একদিনের ব্যবধানে বন্দরবাজারে আমদানিকারকরা পিয়াজ বিক্রি করছেন ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে। হঠাৎ দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েন পিয়াজ কিনতে আসা পাইকাররা।

ক্রেতারা জানান, শুল্ক আরোপের খবরে দেশের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ৪০ শতাংশ শুল্কসহ এলসি করা পিয়াজ এখনো দেশে আসেনি। কিন্তু ভারত সরকারের এ ঘোষণার পরই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আগের দামে কেনা পিয়াজের দাম নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

জানা গেছে, সরবরাহ সংকটে বাংলাদেশেও পিয়াজের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয় মৌসুম শেষ না হতেই। লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েক দিনের ব্যবধানেই পিয়াজের দামে সেঞ্চুরি হয়। তখন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ১৪ই জুন পিয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সরকার। ভারত থেকে তখন পিয়াজ আসা শুরু হলো দাম পড়তে থাকে। তবে গত সপ্তাহ থেকে আমদানিতে গতি কমলে আবার দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে।

দেশের বৃহত্তম কাঁচাবাজার কাওরান বাজারের পিয়াজের আড়তে ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দামে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে। একদিন আগেই যে আড়তদার প্রতি পাল্লা বা ৫ কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি করেছেন ৩৮০ টাকায়, সেই আড়তদারই একদিনের ব্যবধানে দাম হাঁকাচ্ছেন ৫০০ টাকা। বেশির ভাগ আড়তদার ৪৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। যা খুচরা বাজারে গেলেই ১০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। আমদানি করা পিয়াজেও একই চিত্র দেখা গেছে। এক বিক্রেতা বলেন, পাবনা থেকে পিয়াজ আনি। সেখানে দামও বাড়িয়েছে, পিয়াজও কম ছাড়ছে।

শ্যামবাজারের পিয়াজ আমদানিকারক হাজী মো. মাজেদ বলেন, ভারত পিয়াজের রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়ায় এখন আমদানির খরচ বাড়বে। এর আগে আমরা প্রতি টন পিয়াজ ৩০০ ডলারের আশপাশে কিনেছি। এখন সেখানে খরচ বাড়বে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।

পিয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন কৃষকের হাতে পিয়াজ নেই। যতটুকু আছে তা এখন পাইকারি বিক্রেতাদের হাতে। যে কারণে সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। এই অজুহাতে পাইকারি বিক্রেতারা দাম বৃদ্ধির কথা বলছেন।

অথচ দেশি পিয়াজের এই সরবরাহ ঘাটতি পূরণে গত ৫ই জুন থেকে পিয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই ২ লাখ ৯৯ হাজার টনের বেশি পিয়াজ আমদানি হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

গত ১৯শে আগস্ট ভারত নিজেদের মার্কেটের স্থিতিশীলতার জন্য পিয়াজের রপ্তানি মূল্য ৪০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। শনিবার ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত জানায়, যা চলতি বছরের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়াতে রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি এ শুল্ক আরোপ করলো দেশটি। ভারতের এই ঘোষণার পর পরই বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে পিয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

ঢাকার শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়তদার সমিতির সভাপতি হাজী মো. সাহিদ বলেন, ভারতে পিয়াজের ওপর শুল্কারোপের খবরের প্রভাব শ্যাম বাজারেও পড়ছে। ভারত থেকে পিয়াজ পাঠানোর গতি অনেক কমে গেছে। যত দ্রুত পারা যায় ভারতীয় পিয়াজ দেশে আনার চেষ্টা করছি আমরা। কিন্তু ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে এলসি দিতে পারছে না।

কাওরান বাজারের আড়তদার মো. আশরাফুল আলম বলেন, এখন কৃষকের কাছে পিয়াজ নেই। যা আছে বড় মহাজনদের কাছে। তাদের কাছে ৬ টন পিয়াজ চাইলে দিচ্ছে এক টন, দামও বেশি। দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে ভারতীয় পিয়াজ বিক্রেতা হানিফ মিয়া বলেন, আমদানিকারকরাই দাম বাড়াচ্ছেন। ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেবে এমন খবরে বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

কাওরান বাজার থেকে প্রতি পাল্লা ৪০০ টাকা দরে এক মণ দেশি পিয়াজ কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন মুদি দোকানি শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, মনে করেছিলাম দাম বাড়ার আগেই এক চালান পিয়াজ কিনে নিয়ে যাবো। এখন কিনতে এসে দেখি দাম ঠিকই বেড়ে গেছে। প্রতিকেজি ৮০ টাকা দরে পিয়াজ কিনে কত টাকায় বিক্রি করবো সেটাই ভাবছি।

এদিকে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, মাঠ পর্যায় থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশের কৃষকদের কাছে এখনও তুলনামূলকভাবে পিয়াজের ভালো মজুত আছে। এ কারণে ভারতের শুল্ক আরোপ দেশে পিয়াজের দামে তেমন প্রভাব ফেলবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, শুল্ক আরোপের ঘোষণায় এখন দাম কিছুটা বাড়লেও কয়েকদিন পর কমে আসবে। তিনি বলেন, প্রয়োজনে তুরস্ক, মিশর ও চীন থেকে পিয়াজ আমদানির চেষ্টা করা হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে কৃষিমন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত ১৩ লাখ টন পিয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশে এসেছে তিন লাখ টন। এর অর্থ হলো দেশেও পর্যাপ্ত পিয়াজ আছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর ধরে দেশে পিয়াজের বার্ষিক উৎপাদন ৩৫ লাখ টনের বেশি। আর পিয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। উৎপাদন বেশি হলেও আমদানি করতে হয় কারণ ২৫ শতাংশ বা তারও বেশি উৎপাদিত পিয়াজ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা জটিলতায় নষ্ট হয়ে যায়।

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আমদানিকারকরা গত দুই মাসে ১২ লাখ ৩৪ হাজার টনের বেশি পিয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছে। যেখান থেকে আমদানি হয়েছে ২৪.২৩ শতাংশ। এতে করে বাজারে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।

তবে আমদানিকারকসহ পিয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে সরকার যে হিসাব দেখাচ্ছে, পিয়াজের উৎপাদন তার চেয়ে কম। সে কারণেই সংকট আছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আগামী দুই-তিন মাস পিয়াজ আমাদেরকে ব্যাপকভাবে ভোগাতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়কে মে মাসের শুরুতেই বলা হয়েছিল আমদানির অনুমতি দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা সেটা দেয়নি। উল্টো বলেছে, দেশে পিয়াজের অভাব নেই।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ দেশে যে কোনো অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়ানোই ব্যবসায়ীদের প্রবণতা। পিয়াজের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। বাড়তি শুল্কায়নের পিয়াজ এখনো দেশে আসেনি। অথচ খবর শুনেই সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানো হলো। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=70384