২২ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:২১

ইসিতে দুর্নীতির অভিযোগ

সরবরাহের কাজে মন্ত্রীর ছেলে-সচিবের ভাই

সরকারের প্রায় দেড় কোটি টাকা গচ্চা

ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে শনাক্তকরণ চিহ্ন হিসাবে ভোটারের আঙুলে লাগানো হয় অমোচনীয় কালি। এই কালির দাম কত হতে পারে-এমন প্রশ্ন কারও মনে হয়তো উদয় হয় না। দাম সম্পর্কে ভোটারদের কোনো ধারণাও নেই।

তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রায় ছয় কোটি টাকায় এই কালি কিনছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অতি মূল্যবান এ কালি কেনার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর ছেলে এবং এক সচিবের চাচাতো ভাইয়ের যৌথ সিন্ডিকেট। সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ার পরও তাদের মনোনীত প্রতিষ্ঠানকেই নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেওয়া হয়েছে।

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে নিয়ম ভেঙে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ঠিকাদাররা ফাঁস করেছেন চাঞ্চল্যকর এই তথ্য। কমিশনের কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির এ অভিযোগ গড়িয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের টেবিলে। পরে অভিযোগকারীকে স্ট্যাম্প কেনার আরকেটি কাজ দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

প্রাপ্ত নথিপত্রের তথ্যমতে, কালি কেনার জন্য ২০ জুন ইজিপি প্রক্রিয়ায় পুনঃদরপত্র আহ্বান করে নির্বাচন কমিশন। টেন্ডার জমা দেওয়ার শেষদিন ছিল ২০ জুলাই। ওইদিনই টেন্ডার ওপেন করে জানা যায়, চারটি প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ কোটি ৭০ লাখ ১ হাজার ৯১৫ টাকা দর দেয় প্রভাবশালী এক মন্ত্রী ও এক সচিবের চাচাতো ভাইয়ের সিন্ডিকেটের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাবর অ্যাসোসিয়েটস। এই প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের কেনাকাটায় হরহামেশাই কাজ বাগিয়ে নেয়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এ অ্যান্ড এ ট্রেডার্স।

এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মাগুরার এক আওয়ামী লীগ নেতা। চায়না অরিজিন কালির জন্য তাদের দর ছিল ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৩১ হাজার ১২৫ টাকা। তৃতীয় সর্বনিম্ন ৪ কোটি ৮৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৫ টাকা দর দেয় আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড। আর সর্বনিম্ন ৪ কোটি ৩২ লাখ ১ হাজার ৫২০ টাকা দর দেয় যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শৈলী এন্টারপ্রাইজ।

সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দরের পার্থক্য ১ কোটি ৩৮ লাখ ৩৯৫ টাকা। অর্থাৎ সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ায় রাষ্ট্রের এই বিপুল টাকা গচ্চা যাচ্ছে। দরপত্রে অংশ নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটির নমুনা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ল্যাবে পাঠানো হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করা করার শর্তে এক ঠিকাদার বলেন, ‘দরপত্রের সব শর্ত মেনেই শৈলী এন্টারপ্রাইজ টেন্ডারে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠানটি চায়না থেকে আনা অরিজিন টেস্ট রিপোর্টও সাবমিট করেছিল। কিন্তু কাজ না দেওয়ার মতলবেই তাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়নি। ‘ফোর্থ লয়েস্টকে’ কাজ দিয়ে সরকারের প্রায় দেড় কোটি টাকা জলে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। জনগণের ট্যাক্সের এই টাকা গচ্চা দেওয়ার কোনো মানে নেই। তিনি আরও বলেন, যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নমুনা পরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠানো হয়েছিল, সবকটির রিপোর্ট বেঞ্চমার্কের ওপরে ছিল।

তিন প্রতিষ্ঠানের নমুনা পরীক্ষা করে টেন্ডারে অংশ নেওয়া চার প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন কীভাবে করা হয়েছে, তাও বোধগম্য নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে ওই ঠিকাদার বলেন, ‘মৌখিকভাবে বিষয়টি কমিশন সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবহিত করা হয়েছে। তারা কেউ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দেওয়ার যুক্তিসংগত কারণ বলেননি।

সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ-একই টেন্ডার আগেও একবার আহ্বান করেছিল নির্বাচন কমিশন। তখন বাবর অ্যাসোসিয়েটস দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছিল। অজানা কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে না পেরে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে কমিশন সচিবের দাবি, তখন কারও নমুনাই মানের সঙ্গে না টেকায় রিটেন্ডার করা হয়েছে।

জানা যায়, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় ৬ আগস্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর ই-মেইলে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন এএইচএম জাহিদুর রেজা নামের এক ঠিকাদার। অভিযোগপত্রে তিনি দাবি করেন, তার প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড এ ট্রেডার্স দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে।

কিন্তু সরকারি আইন ও বিধি না মেনে সর্বোচ্চ দরদাতা বাবর এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কালি কেনার নোয়া দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৩৯৫ টাকা বেশি দর দিলেও বাবর অ্যাসোসিয়েটসকে কালি সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে তিনি জমা করা নমুনা বুয়েট ল্যাবে পুনঃপরীক্ষার মাধ্যমে ন্যায়বিচার দাবি করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাবর অ্যাসোসিয়েটস নামের যে প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশ পেয়েছে, সেটির নেপথ্যে দেখভাল করেন প্রভাবশালী এক মন্ত্রী ও এক সচিবের চাচাতো ভাই। প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্র খোলার দিন বেলা ১১টার দিকে ওই মন্ত্রী ফোনে তদবির করেন বলে অভিযোগ আছে। একাধিক ঠিকাদারের অভিযোগ, ভোটের উপকরণ হিসাবে অমোচনীয় কালি কেনাকাটার পুরো প্রক্রিয়ায় পণ্যের মান নিশ্চিত করার বিষয়টি ভাবা হয়নি। ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দরকষাকষির ব্যবস্থাও ছিল না। প্রভাবশালীদের তদবিরেই অতিরিক্ত দর প্রস্তাব করার পরও বাবর অ্যাসোসিয়েটসকে নোয়া দেওয়া হয়।

পিপিআর বিধিমালা উপেক্ষা করে কেন সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে নোয়া দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টের আলোকে টেন্ডার ইভালুয়েশন কমিটি মূল্যায়ন করে আমার কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানোর পর বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কে পারসু করেছে, তা আমার জানা নেই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টেকনিক্যাল কমিটি ফোর্থ লয়েস্টকে কাজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। আমাকে মৌখিকভাবে তারা জানিয়েছেন, যেগুলো টেস্টে গিয়েছে, সেগুলোয় যে পরিমাণ ইনগ্রিডিয়েন্স থাকার কথা, সেই পরিমাণ ইনগ্রিডিয়েন্স ছিল না বিধায় টেস্টের রিপোর্টের আলোকে তারা ফোর্থ লয়েস্টকে সুপারিশ করেছেন। ফোর্থ লয়েস্ট হওয়া প্রতিষ্ঠানের নমুনাই শুধু মানের সঙ্গে টিকেছে বলে টেকনিক্যাল কমিটি আমাকে জানিয়েছে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজনের নাম যদি জড়িয়ে থাকে, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি তারা যদি কোনো বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা আমার ভাই, পিতা-পুত্র যেই হোক-কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

আমার আত্মীয়স্বজন থাকবে, ভাই থাকবে। ভাই থাকাটা তো কোনো অপরাধ না। এখন কেউ যদি একটা কাজ না পেয়ে বলে অমুকের ভাই পারসু করছে। আমার ভাই কি আমার রুমে আসবে না? আমি বলব, প্রথমবারের মতো ইসির কেনাকাটায় দুইশ ভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এরপরও যদি কোনো টেন্ডারদাতা সংক্ষুব্ধ হন, পিপিআর অনুযায়ী সিপিডিওতে আবেদন করবে। সিপিডিও সেসব আবেদন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত নোয়া বন্ধ থাকবে।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/709354