২২ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:১৪

সরকারের ‘ধারাবাহিকতা’ ও নির্বাচন ‘নিরপেক্ষ’ করার কথা পরস্পরবিরোধী

একদিকে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ার দাবিও করা হচ্ছে। এটি পরস্পর বিরোধী চিন্তা ও কৌশল বলে মনে করছেন পর্র্যবেক্ষকগণ। নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে নিলে অন্য কেউ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে। এতে সরকারের অতি ‘বিচলিত’ মনোভাব প্রদর্শনে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন সরকার ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতার’ সঙ্গে ‘সরকারের ধারাবাহিকতার’ বিষয়টিকেও মিলিয়ে দিয়েছে। এ কথার সরল অর্থ হলো, ‘উন্নয়নের’ প্রয়োজনে বর্তমান সরকারের অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকা দরকার। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কয়েক বছর পর পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটের রায়ের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়। জনগণ কাকে ক্ষমতায় রাখার ইচ্ছা করবে তা অনিশ্চিত। কেননা তা কারো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘সরকারের ধারাবাহিকতা’ বজায় থাকবেই এমন কোনো গ্যারান্টি থাকার কথা নয়।

প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের ‘অঙ্গীকার’ ব্যক্ত করে চলেছেন। বিশেষ করে বিদেশী প্রতিনিধিদেরকে এবিষয়ে নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন। বিদেশীদের তাগিদ অনুযায়ী আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে রেখে কিভাবে বিদেশীদের ম্যানেজ করে নির্বাচনের আয়োজন করা যায় সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গত এক দশকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে কী পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল এবং এগুলো দেশে-বিদেশে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে কি-না, সে প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। তারা এককথায় তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হওয়ার সাধারণ দাবি করে আসছেন। তবে জনগণের দাবি অনুযায়ী একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্র্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি মেনে নিতে কেনো রাজি নয়- সে প্রশ্নেরও উত্তর মিলছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যদি ‘সরকারের ধারাবাহিকতা’ নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে তা সম্ভব নয়। একজন বিশ্লেষক উল্লেখ করেন, “আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে হলে সেই নির্বাচনে এমন সব ‘প্রতারণাপূর্ণ কারসাজি’র আশ্রয় নিতে হবে, যাতে আওয়ামী লীগকে ‘বিজয়ী ঘোষণার’ নিশ্চিত গ্যারান্টি থাকে। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এধরনের ‘ভুয়া বিজয়ের’ ব্যবস্থা করতে হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার একেবারে উলঙ্গভাবে এই নীতি প্রয়োগ করে নির্বাচনী কারচুপির মাধ্যমে দেশের ওপর ‘সরকারের ধারাবাহিকতা’ চাপিয়ে দিয়েছিল। আগামী নির্বাচনেও সে রকমই করতে চাইছে।”

তার মতে, এ কারণেই আওয়ামী লীগ ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তদারকি সরকারের’ দাবিকে এক কথায় নাকচ করে দিয়েছে এবং ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই’ এবং ‘পার্লামেন্ট বাতিল না করেই’ নির্বাচন হবে বলে গোঁ ধরে বসে আছে। এ রকম গোঁ ধরা ছাড়া দলটির আর কোনো উপায় নেই। জনগণের ভোটের রায়ের ওপর নির্ভর করলে আওয়ামী লীগের পরাজয় যে নিশ্চিত, সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। এমনকি আওয়ামী লীগেরও নেই। কিন্তু যে করেই হোক পরাজয় ঠেকাতেই হবে!

বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা আর সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ার দাবি যে পরস্পরবিরোধী সেটি বুঝেও সরকারি মহল ক্ষমতা নিশ্চিত করার পথেই হাঁটছে। এজন্য তারা প্রতিবেশি দেশের জোরালো ভূমিকা নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। এজন্য সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরও করেন। তিন দিনের এই ভারত সফরে তারা ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিজেপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও বৈঠক করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি’র সভাপতি এবং নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বৈঠক। আর এই বৈঠকে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি নাকি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা চান তারা। আওয়ামী লীগ যেন ক্ষমতায় আবার আসতে পারে, এই বার্তাটি কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিজেপি’র সভাপতি জেপি নাড্ডা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বর্তমান সরকার আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে না পারলে ভারতের স্বার্থের ক্ষতি হবে বলেও বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনের পরিণতি কী দাঁড়াবে সেটিও বলার অপেক্ষা রাখে না বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

এর আগে চীন সফরে গিয়ে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় চীনকে ‘পাশে পাওয়া’র আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক তিন বামপন্থী দলের নেতারা। জবাবে চীনা কর্তৃপক্ষ নাকি বলেছে, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ তারা পছন্দ করছে না। চীন সফর করে দেশে ফেরার পর প্রতিনিধিদলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে চীনা কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিনিধির মুখ থেকে সরাসরি এবিষয়ে কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং সাম্যবাদী দলের (এমএল) শীর্ষ নেতারা গত ২৪ থেকে ৩০ জুলাই চীনের কুনমিং সফর করেন। এই সফরে নিজ নিজ দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যখন বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে তৎপর রয়েছে তখন সরকার সমর্থক মহল থেকে একে বাংলাদেশে ‘বিদেশী হস্তক্ষেপ’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ এর বিপরীতে দৌড়ঝাঁপ চলছে সরকারের পক্ষে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিদেশী সমর্থন আদায়ের। আগামী নির্বাচন যেকোনো প্রকারে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে আয়োজন করে নিজেদের বিজয় ‘নিশ্চিত’ করার জন্য ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর ফলে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের আশা দুরাশায় পরিণত হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

https://www.dailysangram.info/post/533351