২১ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৬:১৮

বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ

খেলাপি ঋণের ৮৯ ভাগই আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ

অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করছে। কিন্তু তার বড় একটি অংশই আদায় হচ্ছে না। বছরের পর বছর এসব ঋণ আদায় না হওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ। এতে বাড়ছে ব্যাংকের ঝুঁকির মাত্রা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে গত বছর শেষে ব্যাংকের আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৯ শতাংশ, যেখানে ঠিক ১০ বছর আগে ২০১২ সাল শেষে ছিল ৬৬.৭ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সময়ে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের নীতিমালা শিথিল করা, প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা ও ব্যাংক পরিচালকদের কেউ কেউ ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ায় এ আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর এ মন্দ ঋণ সামাল দিতে আয়ের বড় একটি অংশ দিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এর পরেও কুলাতে না পেরে কোনো কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে আয়ের একটি বড় অংশ আয় খাতে নিতে পারছে না। এসব আয় ব্যাংকের খাতে স্থগিত করে রাখতে হচ্ছে। সবমিলেই ব্যাংক খাতে চাপ বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১২ সাল শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৬৬.৭ শতাংশ ছিল আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ। যেখানে সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ ছিল ১৪.২ শতাংশ এবং নিম্নমানের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪.৮ শতাংশ। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যেমন ২০১৩ সালে ছিল ৭৮.৭ শতাংশ, ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ৮৪.৬ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা আরো বেড়ে হয় ৮৭ শতাংশ। এ ধারা চলতে থাকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ২০২১ সালে তা আরো বেড়ে হয় ৮৮.১৭ শতাংশ। আর বিদায়ী বছর শেষে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮৯ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে গেলে নানা সঙ্কট বেড়ে যায়। প্রথমেই এসব ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। এসব সুদ স্থগিত রাখা হয়। দ্বিতীয়ত, ধারাবাহিকভাবে এক বছরের বেশি সময় ঋণ আদায় না হলে ওই ঋণ মন্দ ঋণ হয়। আর একবার মন্দ ঋণ হলে তা আদায়ের জন্য ব্যাংকের মামলা করতে হয়। আর মামলা চলে দীর্ঘ দিন ধরে। এতে মামলা চালাতে ব্যাংকের যেমন ব্যয় হয়, তেমনি দীর্ঘসূত্রতার কারণে এসব ঋণ আদায়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর একাধারে তিন বছর মন্দ ঋণ হলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা হয়। করা হয় অবলোপন। এভাবে এসব ঋণ ব্যাংকের সম্পদের ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এসব ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যাংকের নিট আয় কমে যায়। এতে বছর শেষে শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে লভ্যাংশ বিতরণ কম করতে পারে। অনেক ব্যাংকের মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতেই আয় শেষ হয়ে যায়। এর পরেও অনেকের প্রভিশন ঘাটতিতে পরে। সবমিলেই ব্যাংকের রেটিংও খারাপ হয়ে যায়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক শ্রেণীর ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু ওই সব ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নেয়া যাচ্ছে না। বরং নিত্যনতুন উপায় উপকরণ বের করে ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ বের করে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল করা হয়। যেমন- মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের জন্য ঋণ নিয়মিত করা হয়। যেখানে নীতিমালা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে খেলাপি হলে ১৫ শতাংশ এককালীন নগদ অর্থ পরিশোধ করতে হতো। পরের ধাপে আরো বেশি হারে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সেখানে মাত্র ২ শতাংশ পরিশোধ করে ঋণ নিয়মিত করে আবার ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ বের করে নেয়া হচ্ছে। আবারো ওই সব ঋণখেলাপি হচ্ছে। আবারো নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত করে নতুন করে ঋণ নেয়া হচ্ছে। এভাবে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর পুঞ্জীভূত ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কমাতে হলে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বাড়তেই থাকবে, বৈ কমবে না।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/771399