২১ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৬:১২

উন্নয়নের জন্য উন্নয়নের স্বার্থে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বাংলাদেশের অর্থনীতি চলে স্বমহান গতিতে, একটি আন্তঃসহায়ক সলিলা শক্তির (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) বলে, শত সহস্র কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী আমজনতার নিরলস পরিশ্রমের ফসলে ঋদ্ধ হয়। একটি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (বা জিডিপি) হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ওই দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম, পুঁজি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবাজাত দ্রব্য উৎপাদন করা যায় টাকার অঙ্কে তার হিসাবকে বোঝায়। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ওই উৎপাদন গত বছরের তুলনায় এ বছর কি হারে বাড়ছে তার পরিমাণ বোঝায়। জিডিপির প্রবৃদ্ধি সংগঠিত হয় শ্রমশক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ, পুঁজি সঞ্চয় (ভৌত ও মানব), প্রযুক্তির পরিবর্তন ইত্যাদির অবদানের কারণে আর এগুলোকে বলে উৎপাদনের উপকরণ বা ফেক্টরস অব প্রডাকশন। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে অর্থাৎ সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি ঘটলে মানুষের কর্মসংস্থান, আয় ও জীবনকুশলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে এবং একই সাথে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আবার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটায়। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে জিডিপির অগ্রগতি সাধিত হয় বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে জীবনযাত্রার মান বাড়ার কথা।

সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি স্থির থাকলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে সমাজে সবার কিছু না কিছু আয় বাড়ে; যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যান্য সব সমস্যার সমাধান করে দেয়। যেমন- সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন, সুস্থতা, শিক্ষা (খাদ্য ও সার্বিক নিরাপত্তা) ইত্যাদি। যা কিনা আবার উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজন। লক্ষ করতে হবে, সব কিছুর ওপর এটি সত্য যে, জিনিস বা সম্পদ উৎপাদিত হতে হবে এবং সম্পদ ও সেবা যা উৎপাদিত হবে তাই-ই জিডিপি হিসাবায়নে জরুরি। টাকা থাকলে বাঘের চোখ কেনা যায় বটে; কিন্তু টাকা থাকলে যে উন্নয়ন চোখে দেখা যাবে এমন কোনো কথা নেই। পণ্য ও সেবা উৎপাদন ছাড়া টাকা উপার্জিত হলে তা জিডিপির উপাদান হিসেবে কিংবা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কোনো অবদান হিসেবে হিসাব কষার কোনো সুযোগ নেই।

রাজশাহীর আলু উৎপাদনকারী জিডিপিতে সরাসরি অবদান রাখেন, যখন এক কেজি আলু ছয় টাকা দামে বিক্রি করেন পাইকারের কাছে। এখানে জিডিপিতে এক কেজি আলুর উৎপাদন ছয় টাকায় স্বীকৃত হয়। কিন্তু এ আলু রাজধানীতে আসার পথে এবং ঢাকার কারওয়ান বাজারে সিন্ডিকেটেড বাজার ব্যবস্থাপনার চাঁদাবাজি বাবদ কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা অতিরিক্ত চাঁদাবাজি ও আদায়সূত্রে অর্জন করলে সে টাকা জিডিপির হিসাবে আসবে না। কেননা, অতিরিক্ত এ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত কোনো সম্পদ তৈরি হয়নি। এটি অর্জিত হয়েছে কোনো বিনিয়োগ ছাড়া। এ অর্থ উপার্জন জিডিপি পদবাচ্য নয়; বরং এই ৩০ টাকা অপব্যবহৃত হয়ে অর্থনীতিকে অনুৎপাদনশীল খাত অপব্যয়িত হয়ে দেশ ও সমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। কেননা, এই ৩০ টাকা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির কাজে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়ে নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ করে তোলে। সমাজে সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় বৈষম্য সৃষ্টি করে। ২৫ কোটি টাকায় একটি সেতু নির্মাণ প্রাক্কলন করে প্রকৃত ব্যয় ৬৫ কোটি টাকায় বেড়ে গেলে ৪০ কোটি টাকার বর্ধিত ব্যয় জিডিপির হিসাবে অর্থবহরূপে ধর্তব্য হবে না এ জন্য যে, সেতু তো সেই একটিই পাওয়া গেছে। বাড়তি ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে একাধিক সেতু তৈরি হয়নি। সুতরাং প্রকৃত সম্পদ ও সেবা সৃষ্টি ছাড়া এডিপির বিশাল ব্যয় জিডিপির বপুতে টাকার অঙ্কে যোগ করা বা উন্নয়ন হিসেবে প্রচার প্রগলভতার যৌক্তিকতা নেই।

কর্মচারীকে বেতন দেয়া হয় কাজের বিনিময়ে। অর্থাৎ তার দ্বারা সম্পদ ও সেবা সৃষ্টির বিপরীতে এ ব্যয়। কিন্তু তাকে দিয়ে কোনো কাজ না করিয়ে বসিয়ে বসিয়ে যদি বেতন দেয়া হয়, কিংবা যারা কাজ করছেন তাদের অস্বাভাবিক পারিতোষিক ও ভৌত সুবিধা দেয়া হয় তাহলে গুণগতমানসম্পন্ন অতিরিক্ত গুডস অ্যান্ড সার্ভিস (জনসেবা, পরিষেবা ) উৎপাদন ছাড়াই তার পেছনে অর্থ ব্যয় করা হবে। এ ব্যয় জিডিপির শরীরে অপাঙ্ক্তেয়। সুতরাং সম্পদ ও সেবা উৎপাদন, সে সম্পদের সংরক্ষণ, সেবাকর্মে সুশাসন, জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকলে জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধি।

৩৫ হাজার ইলিশ মাছের দাম সাত কোটি টাকা। এ দাম ১৪ কোটি টাকা হলে কোনো উপকার নেই; যদি আরো ৩৫ হাজার অতিরিক্ত ইলিশ উৎপাদিত না হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে প্রকৃত উৎপাদন, ক্রয়ক্ষমতা, চাহিদা ও সরবরাহের সমন্বয় না হলে খামোখা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জিডিপির জন্য দুঃসংবাদ, অর্থনীতির পুষ্টিহীনতার লক্ষণ। উন্নয়নে অবশ্য আয় বৃদ্ধি দরকার হবে যদিও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটলে জনগণের উন্নয়ন ঘটবে- এটি নিশ্চিত নয়; আর এ জন্য বলা হয়ে থাকে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি উন্নয়নের দরকারি শর্ত পূরণ করে, যথেষ্ট শর্ত পূরণ করে না। আয় বৃদ্ধি ঘটলে অমরত্ব না হলেও অন্তত রোগ-শোক, দুর্দিন-দুশ্চিন্তামুক্ত অপেক্ষাকৃত একটি দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হতে পারে, এ দীর্ঘ জীবন কত দীর্ঘ? অনুমান করা যেতে পারে- গড়পড়তা ৭০-৭৫ বছর বাঁচতে পারাটা স্বস্তিদায়ক, ৭৫-৮০ বছর টিকে গেলে আরো বেশি ভালো এবং ৮০ বছরের ওপর বাঁচতে পারলে তো কোনো কথাই নেই। তবে দেখার দরকার হবে, সময়ের বিবর্তনে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের আয়ুও বাড়ছে কি না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৮২০ সালে ভারতে গড় আয়ু ছিল ২১ বছর এবং যুক্তরাজ্যে ৪০ বছর, কিন্তু ১০০ বছরের ব্যবধানে ভারতে গড় আয়ু মাত্র তিন বছর বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ বছর আর একই সময়ে যুক্তরাজ্যে ১০ বছর আয়ু বেড়ে ৫০ বছরে পৌঁছে; তারও প্রায় ১০০ বছর পর (১৯৯৯) ভারতে প্রত্যাশিত আয়ু ছিল ৬০ বছর এবং যুক্তরাজ্যে ৭৭ বছর এবং বাংলাদেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ১৯৮১ সালে ছিল প্রায় ৫৫ বছর আর ২০২২ সালে প্রায় ৭৩ বছর।

সুতরাং অমর্ত্য সেন যেমনটি বলেছেন- ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাথাপিছু আয়কে গৌরবান্বিত করে কিন্তু এ প্রক্রিয়া আয়ের বিতরণ, বিন্যাস ও মাত্রাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।’ মোটা হওয়া মানে বলবান হওয়া নয়। আবার অনেকে আয়শূন্য অবস্থায় তলানিতে পড়ে থাকলেও কিছু লোকের পর্বত-প্রমাণ আয় বৃদ্ধি মাথাপিছু গড় আয় ওপরের দিকে ঠেলে দিতে পারে যেমন- কারো আয় বৃদ্ধি ঘটাতে পারে ২০০-৩০০ শতাংশ হারে; কারো ১-২ শতাংশ হারে এবং এভাবে সমাজে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে বৈষম্য প্রকট হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দেয়া যাক, বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সালে গড়পড়তা মাথাপিছু আয় ছিল ১০০-১৫০ ডলার। সেই সময় বৈষম্য নির্দেশক গিনিসহগ ছিল বড়জোর ০.৩৫। অথচ মাথাপিছু আয় যখন ৯৮৩ ডলার দাঁড়ায় তখন কিন্তু গিনিসহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৪৭; ২০২০ সালেও মাথাপিছু আয় ২০১০ ডলার, গিনি সহগ? সবার আয় বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু ধনীর বেড়েছে গরিবের চেয়ে অনেক বেশি হারে। অর্থাৎ সময়ের বিবর্তনে বেড়েছে বৈষম্য। কথা হচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রধান সমস্য হলো বৈষম্যের স্তর বড় থাকলে প্রবৃদ্ধির দারিদ্র্য হ্রাসসংক্রান্ত প্রভাবটি দুর্বল হয়ে পড়ে। একটি অপেক্ষাকৃত সাম্যবাদী সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যতটুকু দারিদ্য হ্রাস করাতে পারে, একটি বৈষম্যমূলক সমাজে তার চেয়ে অনেক কম গতিতে দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ বা অর্থনীতি আছে (যেমন- ব্রাজিল, আজিন্টিনা) সেখানে প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। কিন্তু তার বিন্যাস এতটা বেদনাদায়ক এবং নির্মম যে, মনে হবে ওই দেশগুলোতে সার্বিক দারিদ্র্য ও অব্যবস্থাপনা এবং অসচ্ছতা প্রবৃদ্ধিকে উপহাস করছে।

প্রবৃদ্ধি বাড়লে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটতে পারে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি ঘটা মানে উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন যেখানে আছে, সেখানে অবশ্য মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটেছে বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটেছে বলে সেখানে উন্নয়ন ঘটেছে-এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। অপেক্ষাকৃত সাম্যমূলক নীতি গ্রহণ ছাড়া বস্তুত প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন এক সাথে পাওয়া যাবে না। উন্নয়ন ডিসকোর্সে মানুষের ‘স্বত্বাধিকার’ ও সেই স্বত্বাধিকার থেকে পাওয়া ক্ষমতার দিকে নজর দেয়া জরুরি। অমর্ত্য সেন যেমনটি উপলব্ধি করেন- ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি; মানুষ কি করতে পারছে, কি পারছে না, সেটিই উন্নয়ন তত্ত্বের আলোচ্য হওয়ার কথা। মানুষ দীর্ঘজীবন লাভ করছে? অকাল মৃত্যুকে জয় করতে পারছে? তার কি যথেষ্ট পুষ্টির ব্যবস্থা হয়েছে? সে কি লিখতে পড়তে, পরস্পর চিন্তার আদান-প্রদান করতে শিখেছে? সাহিত্যচর্চায় বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পারঙ্গম হয়েছে? ... মানুষের সক্ষমতা প্রসারের প্রক্রিয়াটিই আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।’ বিশ^ব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক প্রবহমান সময়ের সাথে সর্বজনীন সক্ষমতার সাথে চলতে পারাটা প্রকৃত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি। দৈহিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে শরীরে পরিমিত পরিমাণে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, নাইট্রোজেনের উপস্থিতি আবশ্যক, যার অবর্তমানে চিকিৎসাশাস্ত্রমতে ইলেকট্রলিক ইমব্যালান্স অবস্থা দৈহিক চলৎশক্তি বা কার্যক্ষমতা বা নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/771275