মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রয়োজন পুষ্টির। গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত পুষ্টির প্রয়োজন হয় মা ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতার জন্য। ছোট ছোট শিশুর বাড়ন্ত দেহে প্রয়োজন বাড়তি পুষ্টি। শরীরের রোগ প্রতিরোধে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রয়োজনীয় সমন্বিত পুষ্টিতে শরীরের বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণের সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সৃষ্টি হয়। পুষ্টির বদৌরতে একজন সুঠাম, সুদেহী, সুস্থ ব্যক্তি গড়ে ওঠে। এতে তৈরি হয় একটি সুস্থ জাতি। পুষ্টিহীন জাতি সমাজের ক্রমবিকাশে, উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। সচরাচর উদ্যমহীন কর্মবিমুখ জনপদে পরিণত হয়। পুষ্টি ছাড়া জীবন অচল, উদ্যম ও অনুপ্রেরণাহীন ও পশ্চাৎপদ।
পুষ্টির একটি প্রধান মৌলিক উপাদান আমিষ। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে আমাদের নিরাপদ স্বাস্থ্যকর বেড়ে ওঠা, দেহের বৃদ্ধি, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ, কর্মচাঞ্চল্য ও সৃষ্টিমুখিতা সব কিছুর মূলে আমিষের অবদান। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিভিন্ন হরমোন তৈরি এবং দেহে ক্ষারীয় ভারসাম্য রক্ষা করে শক্তিভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে আমিষ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চারিত্রিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিক সঞ্চালন আমিষনির্ভর। আমিষ শরীরের শক্তিভাণ্ডার। আমিষ ছাড়া জীবন অচল।
জীবন ধারণে অতি প্রয়োজনীয় আমিষের প্রধান উৎস হচ্ছে- মাছ, গোশত, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের ডাল, শিমবীজ, বাদাম, সয়া ও মাশরুম। খেয়াল করলে বোঝা যায়, আমিষের বাজারে আগুন। সাধারণ মধ্যবিত্তশ্রেণি ইদানীং মাছ, গোশত, দুধ, ডাল এসবের দিকে তাকাতে বা হাত বাড়াতে সাহস করে না। মসুর ডাল সেই কবে থেকে দৈনিক খাবারের তালিকা থেকে উধাও। শিমবীজ, তাও ছোঁয়া যায় না। মাশরুম ও সয়া কোনোটি মধ্যবিত্তের নাগালে নেই। বিভিন্ন ধরনের বাদামের নাম ভুলতে বসেছে সাধারণ মানুষ। স্বাভাবিকভাবে নাগালের মধ্যে আমিষ ছিল ডিম। রেস্তোরাঁ বাড়িতে মেসে হলে হোস্টেলে আমিষ বলতে ছিল ডিম। এবার সেখানেও হাত পড়েছে সিন্ডিকেটের। মুহূর্তে বাজার থেকে ডিম উধাও; ১৬৫ টাকা ডজন। হঠাৎ ডিমের দামের উল্লম্ফনের দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। মাছ গোশত দুধ ডাল বাদাম নাগালের বাইরে যাওয়ায় ডিমের ওপর স্বাভাবিকভাবে চাপ বেড়েছে। কিন্তু তাই বলে এক লাফে ডিম প্রতি তিন টাকা বেড়ে যাওয়া কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। ডিমের বাজার স্থির রাখতে কর্তৃপক্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে বসেছে যারা মোট চাহিদার ২২ শতাংশ জোগান দেয়। বাকি ৭৮ শতাংশ যারা জোগান দেন তাদের কোনো গুরুত্ব নেই। ভোক্তা অধিদফতর করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে পথ চলতে চাইছে। মনে হচ্ছে, ডিমের বাজারটাও তাদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়ার একটি ব্যবস্থা হচ্ছে। ভোক্তা অধিদফতর দ্রব্যমূল্য-সম্পর্কিত একটি অ্যাপস খুলে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে দ্রব্যমূল্য স্থির রাখতে। যে দেশের সাধারণ মানুষের এই সম্পর্কিত ধারণা শূন্যের কোঠায়। তাদের পক্ষে বিশেষ ধরনের অ্যাপসের ব্যবহার কতটুকু যৌক্তিক। বিষয়টি ভেবে দেখতে ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালককে সবিনয় অনুরোধ করছি। তিনি নিজে বাজারে যান না; যাওয়ার সময় পান না। তার প্রতি অনুরোধ রইল, অতি সাধারণভাবে পারিষদ ছাড়া একবারের জন্য হলেও বাজারে যেতে। শুক্র ও শনিবার অফিস কাজকর্ম বন্ধ থাকে। এই ফাঁকে একদিন সাধারণের সাথে মিশে বাজারে গেলে বুঝতে পারবেন প্রকৃত অবস্থা। বাজার পরিস্থিতি যাচাইয়ের এটি সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।
ডিমের দাম বাড়ানো নিয়ে চলছে দায় চাপানোর খেলা। এটি কে দেখবে, কার দায়িত্ব- এ নিয়ে ঠেলাঠেলি। মাঝখানে ক্রেতার পকেট ফাঁকা। বাণিজ্যমন্ত্রী এবার হুঙ্কার ছেড়েছেন সীমান্ত খুলে দেবেন, প্রতিবেশী দেশের ডিমের বাজারটি চাঙ্গা করতে। এর আগে পেঁয়াজ মরিচ যখন যেটির দাম লাগামছাড়া হয়েছে; আমদানির ব্যবস্থা করেছেন। আমদানিও কিন্তু সিন্ডিকেটের কব্জায় বন্দী। দুষ্টচক্রের কারসাজিতে ডিমের মূল্যে খুব একটা তফাৎ হবে বলে মনে হয় না। একদিকে সিন্ডিকেট নামক শব্দের আড়ালে কিছু মুনাফাখোরের ক্রুর হাসি; অপরদিকে অসহায় জনগণের আর্তি। মাঝখানে কর্তা নামক ব্যক্তিদের নিষ্ফল হুঙ্কার। বারবার একই চিত্র, একই চরিত্র, একই সংলাপ। এখন আবার বায়না ধরেছে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। দাবি করেছে, গোশত আমদানির অনুমতির। এভাবে একদিকে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে আমদানির খেলা বেশ জমে উঠেছে। মাঝখানে দেশের অর্থনীতি ক্রমে আমদানিনির্ভর হওয়ার পথে। এ এক সর্বনাশা খেলা। এ খেলার শেষ কোথায় কে জবাব দেবে?
আমদানির ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার ভুলে যাওয়া হয় যে, আমদানি করে সমস্যার সমাধান হয় না। সাময়িকভাবে সমস্যা চাপা দেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে কার্যকরী উপায় হচ্ছে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা। সাথে সাথে যারা ৭২ শতাংশ ডিমের জোগান দেন তাদের নিয়ে বসা। তারা আগামী বছরে চাহিদার শতভাগ কিভাবে পূরণ করতে পারবেন তার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে প্রণোদনা দেয়া। এ ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশের দুধ আমদানিকারক থেকে বিশ্বের অন্যতম দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের রফতানিকারক দেশে রূপান্তরিত হওয়ার অভিজ্ঞতা উৎসাহ জোগাবে সন্দেহ নেই। নইলে এ বছর আমদানির সুযোগ নিয়ে আগামী বছর এ সিন্ডিকেট হয়তো বলে বসবে, এ বছর মুরগি ডিম দিচ্ছে না তাই আরো আমদানি করা দরকার। দেশের মূল্যবান বিদেশী মুদ্রা এভাবে এই খেকোরা ধ্বংস করে ফেলবে, সন্দেহ নেই।
জনগণের খাবারের তালিকায় আমিষ নেই। এ অবস্থা বেশি দিন চললে প্রোটিন ক্যারোরি ম্যালনিউটেশনে ভুগবে গোটা জাতি। এর দায়ভার কে নেবে? একটি জাতিকে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে পুষ্টিহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। উপরন্তু কৌশলে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। এটি দেখে মনে হচ্ছে, সর্ষের মধ্যে ভূঁত।
নিজের কথা দিয়ে শেষ করব আজকের প্রসঙ্গ। মেডিক্যাল কলেজে পড়ি। তখন আমরা এক টাকায় ডিম কিনেছি ১৬টা। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে। যারা ষাটের দশকে বাজারে যেতেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তারা এর সত্যতা নিশ্চিত করবেন। তখন বিদেশ থেকে ডিম আমদানির প্রশ্ন ওঠেনি। সারা বছর দ্রব্যমূল্যের একটি স্থিরতা ছিল। দেশজ উৎপাদনে চাহিদা মিটত। বলতে পারেন, এখন চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদনও বেড়েছে সমানতালে। অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফনের খেসারত দিতে গিয়ে জনগণ আজ দিশেহারা। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনের চাকা গতিহীন। যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন, অনুগ্রহ করে এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নিন। দয়া করে সিন্ডিকেট ভাঙুন। জনগণকে বাঁচতে দিন। প্রয়োজনে বাজার কাঠামো ও ব্যবস্থাপনার পুনর্বিন্যাস করুন। নিরবচ্ছিন্ন তদারকির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com