১৪ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৫:৫০

প্রসঙ্গ সব দলকে নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন

-আশিকুল হামিদ

বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। জনগণ বুঝুক না বুঝুক অথবা সমথর্ন করুক না করুক, দেশে দেশে গণতন্ত্র বিনাশী ভূমিকা পালনের কারণে নিন্দিত হয়ে ওঠা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন আয়োজন তথা অনুষ্ঠান করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই প্রচেষ্টার গুরুত্ব বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কোনো কোনো জাতীয় দৈনিক বিষয়টিকে ‘বৈশ্বিক তৎপরতা’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। এসব দৈনিকের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনকে নিয়ে এবার বেশ আগেই সরব হয়েছে এবং চীন ও রাশিয়ার পর ভারতও এখন এই নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। উল্লেখ্য, রিপোর্টে ‘ও’ যুক্ত করে ‘ভারতও’ বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের ‘পান থেকে চুন’ পর্যন্ত সকল বিষয়ে গভীরভাবে জড়িত ভারতীয়রা তাদের কৌশল হিসেবে এবার সম্ভবত নির্বাচনের ব্যাপারে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছেন। এরই পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার এবং দলটির পক্ষে অন্য সময়ের মতো প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে ভারতীয়রা কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পেরেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে অবশ্য ‘কাঁচা’ বলেছেন।

এদিকে ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছেÑ ১. সবকিছুর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ; ২. ২০০৫ পর্যন্ত ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকায় থাকা বিএনপির পক্ষেও নীরবতা অবলম্বন করা সম্ভব হচ্ছে নাÑ যদিও দলটির আন্দোলনের কৌশল এখনও সুস্পষ্ট নয়; এবং ৩. পালাবদলের চলমান ঘটনাপ্রবাহে বিএনপির জোটগত পার্টনার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও এগিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করে মামলায় ফাঁসানোর এবং দলটির সমাবেশসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ‘অনুমতি’ না দেয়ার কারণে জামায়াতে ইসলামীকে শুধু পিছিয়েই পড়তে হয়নি, কোনো কোনো এলাকায় আরো একবার ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ও চলে যেতে হয়েছে। দলটির পক্ষে এই সময়ে প্রকাশ্যে অন্তত নির্বাচনমুখী কার্যক্রম চালানো সহজে সম্ভব হচ্ছে না।

মানুষের মুখে মুখে আলোচনা চললেও চলমান ঘটনাপ্রবাহের বিভিন্ন দিক তথা সমগ্র বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা দরকার। কারণ, আওয়ামী লীগ মোটেও এমন কোনো দল নয়, যে দলটি ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান পন্থা নির্বাচনের ব্যাপারে ‘হঠাৎ করে’ একা একা তৎপর হয়ে উঠবে। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিনাকারণে স্যাংশন দেয়াসহ বিভিন্ন পন্থায় পদক্ষেপ নেয়ার মতো দেশ নয়। এসব কারণেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রসঙ্গ প্রাধান্যে এসেছে।

বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা অবশ্য অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। আলোচনা চলছে বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের একতরফা ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে। তারপর এসেছে ২০১৮ সালের ‘মিডনাইট’ ভোটের প্রসঙ্গ। ২০১৪ সালের পর মাঝখানে সাত বছরের বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও জনগণের সচেতন অংশ এখনও ভেবে উঠতে পারেনি, ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জনই যেখানে বিনাভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন এবং বাকি আসনগুলোতেও যেখানে গণতন্ত্রসম্মত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি তেমন একটি সংসদকে কিভাবে ‘হালাল’ করা হয়েছিল এবং ওই এমপিদের সমর্থনের আড়াল নিয়ে ‘গঠিত’ একটি সরকার কিভাবে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেছে! অন্যদিকে ওই সংসদ নিয়মিত অধিবেশনে বসাসহ তার রুটিন ‘কার্যক্রম’ চালিয়ে গেছে এবং মেয়াদও পূরণ করেছে!

মাঝখানে ‘মিডনাইট’ ভোটের বিষয়ে কথা উঠলেও সব দলকে নিয়ে তথা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনা শুরুর পেছনেও রয়েছে ২০১৪ সালের সেই একই জাতীয় সংসদ। বিষয়টি বুঝতে হলে ইতিহাস স্মরণ করতে হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে ‘ঝেঁটিয়ে’ বিদায় করা হয়েছিলÑ সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে ব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনেরই ‘ফসল’ ছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার সংসদে গৃহীত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের মার্চে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। এতে প্রেসিডেন্ট সম্মতি দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ।

ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনার দাবি তুলেছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলো। আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল হয়েছিল দিনের পর দিনÑ এমনকি ১৭৩ দিন পর্যন্ত হরতাল করার কৃতিত্ব পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সরকার দাবিটি মেনে নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছিল বিএনপি সরকার। এর ভিত্তিতে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মনোভাব নিয়ে অবশ্য প্রথম থেকেই প্রশ্ন ও সংশয় ছিল। কারণ, আওয়ামী লীগ শুধু একবারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। তখন বলা হয়েছে, দলটির উদ্দেশ্য ছিল কোনোভাবে একবার ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা কিভাবে স্থায়ী করতে হয় তা দেখিয়ে দেয়া। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী একে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল। বামপন্থী দলগুলোও জামায়াতের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারও সে অনুযায়ী সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী উত্থাপন করে সেটা পাস করিয়েছিল।

১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্য প্রকাশ্যে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, দলটির নেতারা সম্ভবত ভাবতেই পারেননি যে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটবে। ভাবতে না পারার কারণ, নির্বাচনের আগে দলীয় সরকার এমনভাবেই প্রশাসনকে সাজিয়ে গিয়েছিল, যাতে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা না আসতে পারে। অন্যদিকে সেবার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই সরকার জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। একই কারণে ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। ওই নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া আবারও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামী মন্ত্রিত্ব নিয়েছিল। দলটির আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হয়েছিলেন।

ওদিকে জামায়াতে ইসলামী মন্ত্রিত্ব নেয়ায় ক্ষুব্ধ হলেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জনগণের স্বার্থে এমন কোনো ভ’মিকা পালন করেনি, যার কারণে জনগণ আবারও দলটিকে ক্ষমতায় আনার কথা চিন্তা করবে। ২০০৬ সালের নির্ধারিত নির্বাচন এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে দেশি-বিদেশি সকল জরিপেই বরং আওয়ামী লীগের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানানো হচ্ছিল। তখনই শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রের ফলেই ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার ভয়াবহ হত্যা-সন্ত্রাস থেকে নির্বাচন বাতিল করাসহ তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেন ঘটেছিল। প্রমাণিত হয়েছে, সবই আসলে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঘটানো হয়েছিল। জেনারেল মইন উ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে সামনে রেখে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্রকেই শুধু বিদায় করা হয়নি, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যে নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছিল তার মাধ্যমেও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলা যায়, মূলত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী ও দেশপ্রেমিক দলগুলোকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ওই নির্বাচন ছিল বড় ধরনের একটি ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ। এর সঙ্গে কোন কোন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শক্তি জড়িত ছিলÑ ঘটনাপ্রবাহে তারও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

দশম সংসদের ওই নির্বাচনে বড় দলগুলোর মধ্যে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও মূলত বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলের নেত্রীর আসনও গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল বলেই আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়েছিল বাঁকা পথেÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর ভর করেছিলেন। সরকারের পক্ষে একটি রিট আবেদন পেশ করা হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নাকি গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার এবং সংবিধানেরও পরিপন্থী! কারণ, গণতন্ত্র ও সংবিধানের চেতনা হচ্ছে, দেশে সব সময় একটি নির্বাচিত সংসদ বহাল থাকবে। নির্বাচিত সরকারই দেশ পরিচালনা করবে। এই রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলকারীরা আপিল দায়ের করেছিলেন। সে আপিল ও তার রায়ের মূলকথা নিয়ে এখনও বিতর্কের অবসান হয়নি। কারণ, অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হয়েছিল সে রায়টি একদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, অন্যদিকে বিতর্কিত হয়েছে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবেও। কেননা, রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

তাছাড়া এটা ছিল একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে কতজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং তারা ঠিক কি অভিমত দিয়েছিলেন সেকথা কখনও প্রকাশ করা হয়নি। তাছাড়া রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছিল। ক্ষমতাসীনরা বলেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার নাকি ‘আর কোনো সুযোগ নেই’! বলা দরকার, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা কিন্তু সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া সেই অভিমতটুকুর উল্লেখই করেননিÑ যেখানে বলা হয়েছিল, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

অমন একটি সংকীর্ণ এবং নিজেদের স্বার্থ পূরণকারী চিন্তার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়েছিল। রাজনৈতিক সংকটের শুরুও হয়েছিল সেখান থেকেই। বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো প্রথম থেকেই ওই সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে। উল্লেখ্য, ততদিনে চার দলের স্থলে ১৮ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। কিছুদিন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানালেও বেগম খালেদা জিয়া এক পর্যায়ে ছাড় দিয়ে বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা ওই সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গণচীনও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। এজন্য প্রধান দুটি দলকে তারা সংলাপে বসারও পরামর্শ দিয়েছিল।

অন্যদিকে সংলাপের নামে একের পর এক কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটকে মধ্যস্থতা করার এবং একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন (নভেম্বর, ২০১৩)। জবাবে প্রেসিডেন্ট তার ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা শুনিয়ে বলেছিলেন, ১৮ দলীয় জোটের দাবি ও বক্তব্য তিনি সরকারের কাছে ‘পৌঁছে দেবেন!’ এর পরপর একদিকে হঠাৎ করে সংসদ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটিয়ে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন বিধান যুক্ত করার পথ বন্ধ করা হয়েছিল, অন্যদিকে এমন এক অসত্য প্রচারণা চালানো হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট নাকি প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছিলেন! এভাবে শুধু নয়, আরো কিছু পন্থায়ও প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটকে বিতর্কিত করা হয়েছিল।

অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বলেছিলেন, জাতীয় জীবনের অমন এক ক্রান্তিলগ্নে ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট’ই সরকারকে নিবৃত্ত করার পাশাপাশি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ব্যাপারে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট তেমন ভূমিকাই পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন ১৮ দলীয় জোটের নেতারা। প্রেসিডেন্টকে তারা বলেছিলেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকা সহিংসতাকে প্রতিহত না করা গেলে এবং বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো হলে গণতন্ত্র ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ভয়ংকর সে পরিণতির কবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের উচিত সচেষ্ট হওয়া। অন্যদিকে ‘গভীর মনোযোগের সঙ্গে’ তাদের বক্তব্য শুনলেও প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট নিজের ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, তার পক্ষে ১৮ দলীয় জোটের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করা বা তাদের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে তাদের বক্তব্য ও দাবিগুলোকে তিনি সরকারের কাছে ‘পৌঁছে দেবেন’।

দেশপ্রেমিক রাজনেতিক পর্যবেক্ষকরা সে সময় বলেছিলেন, গণতন্ত্র রক্ষাসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই প্রেসিডেন্টের উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এমনভাবে ‘পরামর্শ’ দেয়াÑ যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং ১৮ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করেন। সংসদ তখনও বহাল থাকায় প্রেসিডেন্ট যে কোনো সময় অধিবেশনও আহবান করতে পারতেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। আর সে সুযোগ নিয়েই আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছিল। এর পরই আয়োজিত হয়েছিল এমন এক নির্বাচন, যে নির্বাচনে ১৫৪ জনই বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন!

ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে, সরকার এগিয়েছিল একতরফা নির্বাচনের নীলনকশা অনুযায়ী। বিদেশিদের পরামর্শ ও আহবানের জবাবেও সরকার অনড় অবস্থানেই থেকেছে। মুখে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলা হলেও সে সময় ‘সর্বদলীয়’ সরকারের নামে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মহাজোট সরকারের সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। রাশেদ খান মেনন প্রমুখ মন্ত্রী রাতারাতি আওয়ামী মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এবং আবারও মন্ত্রিত্ব গ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যেন সত্যিই কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ! এই চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি। কারণ, কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিলেও ক্ষমতাসীনরা দেখাতে পারেননি, ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের বিধান সংবিধানের ঠিক কোন ধারায়, অনুচ্ছেদে বা উপ-অনুচ্ছেদে রয়েছে। অর্থাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের ব্যাপারে তারা আসলে সংবিধানই লংঘন করেছিলেন। অথচ গণতন্ত্রের প্রশ্নে সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল অন্তত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে সম্মত হওয়া।

বলা দরকার, নির্বাচন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে নতুন পর্যায়ে কথা উঠলেও এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ মধ্যস্থতার মাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও পর্যবেক্ষকরা কিন্তু আশাবাদী হতে পারছেন না। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়ার জন্য তারা ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন নির্বাচনের উল্লেখ করে বলেছেন. এসব নির্বাচনেও অনেকাংশে একদলীয় নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যই দেখা গেছেÑ যদিও ক্ষমতাসীন দল বিরাট ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারেনি। কোনো কোনো গণমাধ্যমের রিপোর্টে এমনকি একথা পর্যন্ত বলা হয়েছে যে, ব্যাপক আয়োজন থাকা সত্ত্বেও এবং বিএনপি ও জামায়াতের মতো শক্তিশালী দল অংশ না নিলেও ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য উপনির্বাচনে নৌকার তথা আওয়ামী লীগের ৪৪ শতাংশ প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ থেকেও ক্ষমতাসীনদের যেমন শিক্ষা নেয়া উচিত তেমনি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সরব ও তৎপর হয়ে ওঠা বিভিন্ন দেশেরও উচিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে বিরোধী দলগুলোর অভিমত ও পরামর্শ গ্রহণ করা।

https://dailysangram.info/post/532621