১৩ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১:০৩

ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রাতদিন শিশুদের কান্না

ঠাঁই নেই রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু নিয়ে শনিবার অভিভাবকের অপেক্ষা - মাহবুব হোসেন নবীন
ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারে দু’দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছে আত্রীয় সাহা রোদ। আগামী মাসে চার বছরে পা দেবে সে। তার জন্মদিন ঘিরে মা-বাবা ও বড় দুই বোনের কত পরিকল্পনা ছিল! এখন আর সেসব নিয়ে ফুরসত নেই তাদের। ১০ দিনের টানা জ্বরে রোদের শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে। কোনো খাবার মুখে নিচ্ছে না। পেটের ব্যথায় কাতর রোদের এক হাতে ক্যানুলা লাগানো। অতিরিক্ত নড়াচড়ার কারণে ক্যানুলা দিয়ে রক্ত চলে আসছে স্যালাইনের পাইপে। আতঙ্কিত বাবা-মাকে অভয় দিচ্ছেন নার্সরা। তবে নার্স দেখেও এখন ভয় পায় রোদ।

রোদের বাবা প্রকাশ চন্দ্র সাহা রাজধানীর তেজগাঁও থানার কেস রাইটার। তিনি জানান, ১৫ দিন আগে প্রথমে তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের জ্বর হয়। পরে নিজেও আক্রান্ত হন। টেস্টে সবার ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। ছেলের জ্বর এলে ফার্মগেটের আল রাজী হাসপাতালে তাঁর টেস্টেও ফলাফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু তিন দিন পরই ছেলের শরীরে কাঁপুনি দিয়ে আবার জ্বর আসে। শিশু হাসপাতালে এনে টেস্ট করালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সেখানে শয্যা সংকটের কারণে চিকিৎসক বাসাতেই সেবা-শুশ্রূষা করার পরামর্শ দেন। পরে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে একটা শয্যা পান। রোদের মা রিমঝিম সাহা বলেন, ‘ছেলেটা কিছু খায় না। সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। শুকাইয়া কী হইছে! কেউ কাছে আসতে পারে না, ভয় পায়।’

রোদের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ১১৯ শিশু ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। নিচতলায় ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এই দুই ওয়ার্ডে রাতদিন শিশুদের কান্না শোনা যায়। কেউ তিন দিন আবার কেউ জটিল সমস্যা নিয়ে আরও বেশি দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছে।

মাদারীপুর থেকে ঢাকার ফার্মগেটে ননদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন তামান্না খান। চার বছর বয়সী তাঁর একমাত্র সন্তান নূর এসেই জ্বরে আক্রান্ত হয়। টেস্ট করালে ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। গত ২ আগস্ট রাতে আবারও নূরের গায়ে জ্বর আসে। আবার টেস্ট করালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে গত ৫ আগস্ট এই হাসপাতালে ভর্তি করান। তামান্না বলেন, ‘১০ দিন ধরে ছেলেটা জ্বরে আক্রান্ত ছিল। এখন জ্বর না থাকলেও অন্যান্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। হৃদরোগ, লো প্রেশার, রক্তে ইনফেকশনসহ বেশ কয়েটি সমস্যা ধরা পড়েছে। এসব সমস্যা আগে ছিল না।’

এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন তিন বছরের মাশনূন মাহাদী। তার মা মাহমুদা কাকলী বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে ছেলেটা এ হাসপাতালে ভর্তি। তীব্র জ্বরের কারণে খাবারে রুচি নেই। শরীরে এখনও ব্যথা। আজ একটু সুস্থ। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত আরেক শিশুর সঙ্গে খেলছে। কাকলী সমকালকে বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বরে ছেলের শরীরজুড়ে ব্যথা ছিল। শুধু বলত, মা পেট কামড়ায়। কনুই, পায়ের গোড়ালি, মাথার পেছনের অংশে বেশি ব্যথা করত। মুগদা হাসপাতালে রোগীর চাপে বারান্দায়ও সুযোগ হয়নি। ভাগ্যক্রমে এ হাসপাতালে একটা সিট পাইছি। এখন ছেলে সুস্থতার পথে।’

হাসপাতালের রেকর্ড অফিসার মো. আসাদুজ্জামান জানান, ডেঙ্গু কর্নারের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে মোট ৯২টি শয্যা রয়েছে। ওয়ার্ড এবং পিআইসিইউ, আরআইসিইউ ও সিসিএনডিতে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২০ শিশু ভর্তি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে রোগী ভর্তি হয়েছে ১৩ জন। চলতি বছর ভর্তি হয়েছে মোট ৭২৩ জন। ঢাকা ছাড়াও কুমিল্লার ৯ জন, গাজীপুরের ১১ ও লক্ষ্মীপুর থেকে ১১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। বিশেষায়িত ওয়ার্ড ছাড়াও পিআইসিইউ, আরআইসিইউ ও সিসিএনডির ৩৫টি শয্যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছে।

১১ শিশুর মৃত্যু
গত শুক্রবার এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৭ বছরের মুন্নী। বাবা-মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে মুন্নী বড় ছিল। রাজধানীর আদাবরের মনুসরাবাদ হাউজিংয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন মুন্নীর বাবা-মা। তার চাচা রুহুল আমীন মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘৫ আগস্ট মুন্নীর জ্বর ওঠে। পরদিন টেস্ট করালে ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়ে। ৮ আগস্ট রাতে মুন্নীকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ও খাবার খেতে পারত না। শুধু বমি হতো। সময় দিল না আমাদের। ১১ আগস্ট রাত ১২টায় আমাদের ফেলে চলে গেল।’

এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলতি বছর এ পর্যন্ত মুন্নীসহ ১১ শিশু মারা গেছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2308189465