১৩ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১:০২

পরিকল্পনায় ভুল, নকশায় ত্রুটি

এই রেলপথ নির্মাণের পর পাঁচ বছরে তিন বন্যা

পরিকল্পনায় ভুল এবং প্রকল্পের নকশায় ত্রুটির কারণে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন এই রেলপথ দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিশেষ করে সাতকানিয়ায় সাম্প্রতিক বন্যার অন্যতম কারণ বলেও মনে করছেন তাঁরা।

পরিকল্পনায় ভুল, নকশায় ত্রুটিনদী ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অন্য অঞ্চলে প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে। কিন্তু এই অঞ্চলের পানির স্রোত ও পাহাড়ি ঢল পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী।

আর রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী। এতে নির্মীয়মাণ নতুন রেললাইন পানির স্রোতের মুখোমুখি হয়ে চাপ নিতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে দুর্বলতা ছিল তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে এর ভিত্তিতে প্রকল্পের যে নকশা করা হয়েছে তা-ও ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে।

পানির গতিপথের আড়াআড়ি রেলপথ করা হলেও যে সংখ্যায় ও আকারের ওয়াটারপাস বা পানিপ্রবাহের পথ করার দরকার ছিল তা করা হয়নি। ১০০ বছরের বন্যার তথ্য পর্যালোচনা করে এই প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়েছে বলা হলেও এই ক্ষয়ক্ষতি মূলত পর্যালোচনার অসারত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই রেলপথ নির্মাণ শুরুর পর গত পাঁচ বছরে তিনবার বন্যা বা বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় রেলপথের কারণে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারমুখী নির্মীয়মাণ রেলপথের প্রায় ১০ কিলোমিটার। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে রেললাইনের পাথর ও মাটি সরে গেছে। কিছু জায়গায় রেললাইনও সরে গেছে। এ ছাড়া কিছু অংশে মাটি, ঘাস, গাছপালা ডুবে ছিল। এসব ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামত করতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে।

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মীয়মাণ ১০০ কিলোমিটার রেলপথের প্রায় ২৫ কিলোমিটার অংশ পড়েছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়। পুরো রেলপথের মধ্যে এই অঞ্চল তুলনামূলকভাবে অনেক নিচু। ফলে কিছু জায়গায় মাটি থেকে ২০ ফুট উঁচুতে রেলপথের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক প্রবণতায় দেখা যাচ্ছে শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, পথের যে অংশে মাটি উঁচু করে রেলপথ করা হয়েছে সেখানে যদি খুঁটির ওপর রেলপথ বানানো হতো তাহলে পানিপ্রবাহে সমস্যা হতো না। আলাদা সেতু-কালভার্ট ও হাতি চলাচলের পথও তৈরি করতে হতো না। মানুষের চলাচলেও যেমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতো না, তেমনি বিপুল ফসলি জমিও বেঁচে যেত।

যদিও বাংলাদেশ রেলওয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পরিকল্পনা করেই সব করা হয়েছে। এমন বন্যা ১০০ বছরেও হয়নি। প্রয়োজনে এখন আবার বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখা হবে। তবে কাজের মান নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বললে ভুল বলা হবে। ১০০ কিলোমিটার পথে দু-তিন কিলোমিটার ক্ষতি হয়েছে। রেলের বাঁধের জন্য আগে বা এখন বন্যা হয়েছে এটাও ঠিক নয়। বাঁধের দুই পাশেই পানি সমান ছিল। ফলে বাঁধের কারণে পানিপ্রবাহে সমস্যা হয়েছে বলা যাবে না।

কামরুল আহসান বলেন, রেললাইন বেঁকে গেছে, ভুলভাবে এমনটা বলা হচ্ছে। আসলে সব জায়গায় এখনো জয়েনিং ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। তাই কিছু জায়গায় ডিসপ্লেস হয়েছে। এটাকে বেঁকে যাওয়া বলে না।

এরই মধ্যে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে। পুরোপুরি ক্ষতি নির্ধারণ করতে আরো অন্তত দুই দিন সময় লাগবে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মতো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রকল্প সূত্র বলছে, আর্থিক ক্ষতি পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে। কেননা রেলওয়ে এখনো প্রকল্পটি বুঝে নেয়নি। দুর্যোগের কারণে আর্থিক ক্ষতি পোষাতে ব্যয় বাড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, পানিপ্রবাহের বিপরীত মুখে এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর বিশদ নকশায়ও ভুল আছে। স্রোতের বিপরীতমুখী রেলপথ হওয়ায় ক্ষতি এত বেশি হয়েছে। এই ত্রুটিযুক্ত নকশার জন্য বিনিয়োগকারী সংস্থা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, পরিকল্পনা কমিশন, রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ সবার দায় আছে।

আইনুন নিশাত বলেন, এই রেলপথে পানি যাওয়ার পর্যাপ্ত পথ রাখা হয়নি। এখানে শুধু মাটি উঁচু করে রেলপথ বানানো হয়েছে। এটা পরিকল্পিত বাঁধও নয়। এখন এটা ভেঙে নতুন করে বানানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জোড়াতালি দিয়ে ভুলের সমাধান করার চেষ্টা হবে আরেকটি ভুল।

২০২১ সালের আগস্টেও কয়েক দিনের টানা ভারি বৃষ্টি ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি হয়ে পড়ে চকরিয়ার ১৮টি ইউনিয়নের মানুষ। এই রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর পাঁচ বছরে তিনবার বন্যার কবলে পড়েছে এই এলাকার মানুষ।

জানতে চাইলে অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের অন্য জায়গায় পানির প্রবাহ উত্তর-দক্ষিণমুখী হলেও এখানে পূর্ব-পশ্চিমমুখী। এ জন্য রেলপথ খুঁটির ওপর করা জরুরি ছিল। ওই অঞ্চলে কোনো প্রকল্পই বাঁধনির্ভর করা ঠিক হবে না। এই অঞ্চলের জন্য বাঁধ একটি বড় সমস্যা। তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাটে সহজে দুর্নীতি করা যায়। তাই বাঁধের প্রকল্পের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে।

শামছুল হক বলেন, এখন পরিষ্কার হয়েছে প্রকল্প পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের বাধ্যবাদকতার কারণে নামমাত্র একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ভালোভাবে স্ট্যাডি করা হলে তখনই ভবিষ্যৎ সমস্যা চিহ্নিত করা যেত।

প্রকল্পে কর্মরত প্রকৌশলী আবদুল জব্বার মিলন জানান, পুরো পথে ২১৪টি কালভার্ট এবং ১৬টি সেতু রয়েছে। সেই সঙ্গে মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও সাঙ্গু নদীতেও সেতু রয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রতি কিলোমিটারে গড়ে তিনটি ছোট-বড় সেতু আছে, যা দেশের অন্য কোথাও নেই। এ জন্য কালভার্ট অপর্যাপ্ত, এটা বলা যাবে না।

প্রকল্পের পূর্বাপর
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে হাতে নেয় সরকার। প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০.৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের বাকি অংশের কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু। ১৪৯টি বক্স কালভার্ট ও ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। লেভেলক্রসিং রয়েছে ৯৬টি।

চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।

সর্বশেষ জুলাইয়ের প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৮৮ কিলোমিটার লাইন বসানো হয়ে গেছে। ৯টি স্টেশনের কাজ চলমান আছে। স্টেশনের সার্বিক কাজের অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে ডুলাহাজারা স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্পটি ২০১০ সালে অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর সব জটিলতা কাটিয়ে ২০১৮ সালে প্রকল্প নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করে। ফাস্ট ট্র্যাক এই প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সাত লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরো রেলপথের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। আর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে যাত্রী পরিবহন। কিন্তু বন্যার কবলে পরা ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামত করার পাশাপাশি পুরো কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে কি না তা স্পষ্ট নয়। অক্টোবরের শুরুর দিকে ট্রেন চলাচল শুরুর ভাবনা থাকলেও সেখান থেকে সরে আসছে রেল কর্তৃপক্ষ।

প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, বন্যার কারণে যে ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আবহাওয়া ভালো থাকলে তা এই মাসেই মেরামত করা সম্ভব। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় প্রকল্পের উদ্বোধন হতে পারে।

 

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/08/13/1307897