১৩ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১:০০

৩ হাসপাতাল ঘুরে রোকসানার ঠাঁই হলো ঢামেকের মেঝেতে

রোকসানা আক্তার, অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। দেড় বছর আগে বিয়ে করেছেন। এখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রোকসানার জ্বর আসে। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা-কাশি, শরীর ব্যথা। ডেঙ্গু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে তার ঠাঁই হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে। এর আগে তিন হাসপাতাল ঘুরে মেলেনি চিকিৎসা।
রোকসানা মানবজমিনকে বলেন, হঠাৎ জ্বরের সঙ্গে ঠাণ্ডা-কাশি, শরীর ব্যথা ও পা ফুলে যায়। এরপর টাঙ্গাইলের স্থানীয় একটি হাসপাতালে গেলে ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। সেখানে অন্য আরেকটি হাসপাতালে গেলে অন্তঃসত্ত্বা বলে ঢাকায় আসতে বলে। এরপর ঢাকায় মুগদা হাসপাতালে যাই।

সেখানে শয্যা খালি না থাকায় বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি। এখন কিছুটা জ্বর কমলেও ঠাণ্ডা-কাশি কমেনি। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অনেক কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। হাসপাতালে আসার পর থেকেই মেঝেতে আছি। কোথাও সিট খালি নেই। কীভাবে যে ডেঙ্গু হলো বুঝতে পারছি না। সারাক্ষণ বসে থাকতে হচ্ছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয়। পেটের বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি না হয়।

এই নারীর মা ফরিদা বেগম বলেন, আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক ভয় পেয়েছি। যেহেতু ও ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মেয়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে। মেঝেতে ঠিকমতো শুতে পারছে না। এই অবস্থায় কতোক্ষণ বসে থাকতে পারে। শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। প্লাটিলেট অনেক কম। সবার ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে বাচ্চাকে নিয়ে। ব্লাড দেয়া লাগছে।

শুধু রোকসানা নয়, ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেকের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের মেঝেতে। খালি নেই শয্যা। রোগীর চাপ বাড়ায় সাধারণ ওয়ার্ডে চলছে ডেঙ্গু চিকিৎসা। ওয়ার্ডের বাইরে মেঝেতে, সিঁড়ির পাশে থাকতে হচ্ছে রোগীদের। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্স। গতকাল ঢামেক হাসপাতালে সরজমিন দেখা যায়, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে ছুটে আসছেন স্বজনরা। হাসপাতালজুড়ে এম্বুলেন্সের সারি। মিনিটে মিনিটে রোগী আসছে। রোগীদের চাপে ঢামেকের অন্য ওয়ার্ডগুলোতে চাপ বাড়ছে। মেডিসিনের পুরুষ-নারীদের ওয়ার্ডের সবক’টি শয্যা রোগীতে পূর্ণ। নতুন ভবনের ৬ষ্ঠ তলার ৬০১, ৬০২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে পুরুষ এবং অষ্টম তলার ৮০১, ৮০২ মেডিসিন ওয়ার্ডে নারী রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

শিশু ওয়ার্ডেও খালি নেই শয্যা। এখানেও চলছে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা। হাসপাতালজুড়েই যেন রোগী ও স্বজনদের ছোটাছুটি। ঢামেকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ২১ জন, মে মাসে ১১৪ জন, জুনে ৫৮৫ জন, জুলাই মাসে ১ হাজার ৮৭৫ জন, আগস্টে ৮৬৩। গত তিন মাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালটিতে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগী ৩ হাজার ৫১৫ জন। মোট সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ২ হাজার ৩৫০ জন। শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ভর্তি রোগী ছিল ৪৭২ জন (নারী ১৮৯, পুরুষ ২৮৩ জন), ১১ থেকে ২০ বছরের ৭৯১ জন (নারী ২৮৭, পুরুষ ৫০৪ জন), ২১ থেকে ৩০ বছরের ১০৬৫ জন (নারী ৪৩১, পুরুষ ৬৩৪ জন), ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৫৭৫ জন (নারী ২৩৪, পুরুষ ৩৪১ জন), ৪১ থেকে ৫০ বছরের ২৯৯ জন (নারী ১৪০, পুরুষ ১৫৯ জন), ৫১ থেকে ৬০ বছরের ১৮৩ জন (নারী ৮১, পুরুষ ১০২ জন), ৬১ থেকে ৭০ বছরের ৮০ জন (নারী ৪০, পুরুষ ৪০ জন), ৭১ থেকে ৮০ বছরের ৩২ জন (নারী ১৩, পুরুষ ১৯ জন), ৮০ বছরের উপরে ১৮ জন (নারী ৬, পুরুষ ১২ জন)। মোট মৃত্যু ৬৫ জনের। এরমধ্যে ৩০ জন নারী ও ৩৫ জন পুরুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৩ জন। মোট ভর্তি রোগী ছিল ৪২২ জন। ছাড়পত্র পেয়েছে ১২ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের।

ঢামেকের নতুন ভবনের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, চলতি মাসে রোগী আরও বাড়ছে। নতুন ভবনের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে মোট রোগী ভর্তি ১৯৯ জন। এরমধ্যে ডেঙ্গু রোগী ৫৯ জন। পাঁচ জনের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। এই ওয়ার্ডে বেড সংখ্যা ৮০টি সেখানে ১৯৯ জন রোগী নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। লোকবল সংকট রয়েছে, বিশেষ করে এই মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর বিছানা আলাদা করে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। একটা ডেঙ্গু কর্ণার খুব জরুরি এখানে। এক জায়গায় রোগীগুলো থাকলে তাদের সেবা দিতেও সুবিধা হয়। এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের মশারি দিলেও টানাতে অনেক সমস্যা। যেহেতু এক জায়গায় মেডিসিন এবং ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে এখানে অন্য রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকে যায়।

https://mzamin.com/news.php?news=69139