১৩ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১২:৪৩

সিন্ডিকেটের খাঁচায় বন্দী পর্যটন খাত

ট্যুরিজম বোর্ডসহ ৩ সংস্থার সমন্বয়হীনতা দায়ী

সিন্ডিকেটের খাচায় বন্দী দেশের পর্যটন খাত। এ নিয়ে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের এখন লেজেগোবরে অবস্থা। এসবের দেখভালে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ট্যুরিজম বোর্ড, ট্যুরিজম পুলিশ ও পর্যটন করপোরেশন থাকলেও এ বিষয়ে তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে দিন দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সিন্ডিকেট চক্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান কারণ সমন্বয়হীনতা। এর সাথে সংশ্লিষ্ট পর্যটন বোর্ডে, পর্যটন করপোরেশন কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্যর্থতা তাদের মনিটরিংয়ের অভাবে এমনটা হচ্ছে।

আর পর্যটকরা বলছেন, অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটকবান্ধব পরিবেশ কম কিন্তু এখানে খরচ অনেক বেশি। আর এর পেছনে মূল কারণ সিন্ডিকেট ব্যবসা। এর বাইরে পর্যটকদের নিরাপত্তাহীনতা, বিভিন্ন স্পটে যেতে নাজুক রাস্তাঘাট ও যাতায়াত ব্যবস্থা, বিনোদনকেন্দ্র না থাকার কারণে পর্যটকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে সম্ভাবনাময় এ শিল্প বারবার পিছিয়ে পড়ছে। কয়েক মাস আগে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসা পর্যটক রেজওয়ান রহমান জানান, আগে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন অল্প খরচে যাতায়াত করা যেত। আর এখন বিলাসবহুল জাহাজে যেতে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে খরচ হচ্ছে তিন থেকে চার গুণ টাকা। তার মতে, চারজনের একটি পরিবার ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসতে এখন কমপক্ষে খচর হয় এক লাখ টাকা। যেখানে প্রায় একই খরচে একটি পরিবার থাইল্যান্ড ঘুরে আসতে পারে। অথচ থাইল্যান্ডে পর্যটকদের জন্য যে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তার দুই শতাংশও আমাদের দেশে নেই। তাহলে কেন মানুষ এত টাকা খরচ করে বিদেশে না গিয়ে দেশে বেড়াতে যাবে?

তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে যাতায়াতে জাহাজ ভাড়া এবং সেখানে গড়ে ওঠা হোটেলগুলোতে যে পরিমাণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে তা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। আর তাতে একবার যারা সেখানে যান তারা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরে; দ্বিতীয়বার আর যেখানে যাওয়ার চিন্তাও করেন না। এর পেছনে জাহাজ ও হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের বড় সিন্ডিকেট রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এরা পর্যটকদের জিম্মি করে টাকা অতিরিক্ত টাকা অদায়ে বাধ্য করছে। ফলে ঘুরতে গিয়ে অসহায় হয়ে তাদের কাছে পর্যটকদের আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। এতে পিছিয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় এ খাত। একই অবস্থা দেশের অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। তাতে দেখা যায়, প্রতি বছর নভেম্বর থেকে যখন পর্যটন মৌসুম শুরু হয় তখন হোটেল-মোটেলে রুমভাড়া থেকে শুরু করে খাবারের দাম পর্যন্ত কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে সেন্টমার্টিনের পরে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয় কক্সবাজার ও সুন্দরবনে। কক্সবাজারে হোটেল ভাড়া ও খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। আর সুন্দরবনে যাতায়াতে বাড়িয়ে দেয়া হয় জাহাজ ভাড়া।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, এ খাতে একাধিক সিন্ডিকেট থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার প্রধান কারণ হলো সমন্বয়হীনতা। এর সাথে সংশ্লিষ্ট পর্যটন বোর্ডে, পর্যটন করপোরেশন কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্যর্থতা তাদের মনিটরিংয়ের অভাবে এমনটা হচ্ছে। থাইল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে শুধু পুলিশের সাথে সমন্বয় করে তারা তাদের কার্যক্রম চালায়। কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা চিহ্নিত করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। ফলে আজ তারা বিশে^ পর্যটনের মডেল। মালয়েশিয়াসহ উন্নত বিশে^ও তাই। কিন্তু আমাদের সবই লেজেগোবরে অবস্থা। মনিটরিং নেই। জবাবদিহিতা নেই। এগুলো নিয়মের মধ্যে নিয়ে না এলে তার উন্নয়ন অসম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অন্য দিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ ও বিপণন) মো: জিয়া উদ্দিন হাওলাদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ট্যুরিজম ব্যবসা ঘিরে সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন এলাকায় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ খাত। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আইন অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা হলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। এজন্য আরো শক্তিশালী ভূমিকা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে দেশের পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী নয়া দিগন্তকে বলেন, এজন্য পর্যটকদের কিছুটা দায় রয়েছে। কারণ প্রতি বছর নভেম্বর থেকেই তারা ভ্রমণে বের হন। অথবা বছরের লম্বা ছুটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ফলে একসাথে অনেক মানুষের চাপ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পড়ে। এই সুযোগটাই অনেকে নেয়। এজন্য কিছু ক্ষেত্রে অনেকে দাম বাড়িয়ে দেয়। যার প্রভাবটা পর্যটকদের ওপর পড়ে। তাই যারা ঘুরতে পছন্দ করেন তাদের উচিত বছরের একাধিক সময়কে ভ্রমণের জন্য বেছে নেয়া। তাহলে কিছুটা হলেও সিন্ডিকেট সুযোগ কম নেবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/769484