১৩ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১২:২৩

ইন্টারসেপ্টের স্বীকারোক্তি

-আসিফ আরসালান

আজ ঠিক করেছি পাকিস্তান নিয়ে লিখবো। কারণ বিগত ২৯ জুলাইয়ের পর রাজধানী ঢাকা বা দেশের অন্য কোথাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেনি। ২৯ জুলাইয়ের পর গত পরশু অর্থাৎ শুক্রবার বিএনপি একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এর বাইরে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য জামায়াতে ইসলামী এ ব্যাপারে খুব এ্যাক্টিভ ছিল। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় তাদেরকে কোনো জনসভা করার অনুমতি দেয়নি পুলিশ। প্রতিবাদে দেশের প্রায় সব জেলাতেই জামায়াত বিক্ষোভ মিছিল করেছে। রংপুরের বিক্ষোভ মিছিলটি ছিল বিশাল। দেশব্যাপী জামায়াতের এই বিক্ষোভ মিছিল, জামায়াতের সমর্থক নন, এমন অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাজনীতিতে বামপন্থীদের সাথে সম্পৃক্ত এমন একাধিক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করে জামায়াত বিক্ষোভ মিছিল করছে, এটি আমাদের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গণতন্ত্র মঞ্চের একজন বিশিষ্ট কর্মী আমাকে বলেছেন যে, বিএনপিও যদি প্রতিটি সভা- সমাবেশের জন্য পুলিশী অনুমতির অপেক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে বিএনপির রাজনীতি আরো বেগবান এবং শক্তিশালী হতে পারে। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে তারা বলেন যে সভা-সমিতি করার জন্য পুলিশ বা সরকারের অনুমতি নেওয়ার কোনো বিধান শাসনতন্ত্র বা ফৌজদারি আইনে নেই। কেউ সভা বা মিছিল করতে গেলে পুলিশকে সেটি অবগত করা বাঞ্ছনীয়। এজন্য বাঞ্ছনীয় যে কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি বা শক্তি যেন সেই সভা বা মিছিলে গোলযোগ সৃষ্টি করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করবে পুলিশ। সেজন্যই তাদের অবগতির জন্য এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার অনুরোধ করে একটি চিঠি দেওয়া যেতে পারে।

ইচ্ছা আছে পাকিস্তানের ওপর লিখবো। কিন্তু কম্পিউটার খোলার পর দুইটি সংবাদের ওপর আমার চোখ আটকে গেল। একটি গণঅধিকার পরিষদের খবর। আরেকটি হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত খবর। গণঅধিকার পরিষদের ওপর কলাম লেখার কোনো প্রয়োজন আমি অতীতেও অনুভব করিনি, আজও করি না। কিন্তু ফেসবুকে গণঅধিকার পরিষদ নিজেরাই যে খবরটি প্রকাশ করেছে সেটি পড়লে আপনারাও তাজ্জব না হয়ে পারবেন না। আমি নিচে ফেসবুকে প্রকাশিত গণঅধিকার পরিষদের খবরটি কপি পেস্ট করে দিচ্ছি।

“গণঅধিকার পরিষদের স্থায়ী কার্যালয়ের বিষয়ে মালিক পক্ষের সাথে আমাদের আলোচনা মোটামুটি চূড়ান্ত। ১৮,৯০০ টাকা স্কয়ার ফিট মূল্যে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকায় (আলোচনায় আরও কিছুটা কমতে পারে) গণঅধিকার পরিষদের স্থায়ী কার্যালয় ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৫ তারিখের মধ্যে ১ কোটি টাকা বুকিং মানি দেয়া হবে, বাকীটাও দ্রুতই পরিশোধ করা হবে। আমাদের সকল নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভাকাক্সক্ষীদের এ মহতী উদ্যোগে শরিক হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।”

ডাবল ইনভারটেড কমার ভেতরে আমরা তাদের সংবাদটি হুবহু তুলে দিলাম। এ ব্যাপারে কাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাদের নাম ও টেলিফোন নাম্বার এবং ইমেইলও দেওয়া হয়েছে। আমরা সেগুলো বোধগম্য কারণে এখানে উল্লেখ করলাম না। এই খবরটি তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য এই যে মাত্র এক দেড় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সদ্য সাবেক ছাত্রদের একটি দল অফিস কেনার জন্য ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা দিতে পারে কিভাবে? এই ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকার মধ্যে ১ কোটি টাকা আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে অর্থাৎ আর মাত্র ২ দিনের মধ্যে তারা পরিশোধ করবে। অবশিষ্ট ২ কোটি ২৩ লাখ টাকাও নাকি শীঘ্রই পরিশোধ করা হবে। আমরা ভেবে অবাক হচ্ছি যে এক মাসের মধ্যে সোয়া ৩ কোটি টাকা জোগাড় এবং পরিশোধ করা এসব সদ্য সাবেক ছাত্রদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব! রাজনীতিতে একটি কথা আছে। সেটি হলো, ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরি সেন’। এখন যদি কেউ বলেন যে গৌরি সেন এই টাকা জোগাড় করছে তাহলে তাকে দোষ দেবেন কীভাবে? বঙ্কিম চন্দ্রের একটি লেখায় একটি বাক্য রয়েছে। এটি বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। সেটি হলো, ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ এখন গণঅধিকার পরিষদকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘হে যুবক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

॥ দুই ॥
এখন পাকিস্তান প্রসঙ্গে আসবো। তার আগে উল্লেখ করতে চাই যে ১০ আগস্ট হিন্দুস্তান টাইমসে বাংলাদেশে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদটির শিরোনাম এবং প্রথম স্তবকের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। এরপর সংবাদটির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা ঐ স্ক্রিনশট এবং বাংলা অনুবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম। আমরা এখানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই যে এই ধরনের খবর ভারতীয় পত্রিকায় কেন ছাপা হয়? ভারত যদি আমাদের এত বড় বন্ধু হবে তাহলে এই ধরনের খবর কোনো অবস্থাতেই ভারতীয় মিডিয়ায় ছাপা উচিত নয়। আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নজরদারি এড়িয়ে এসব খবর এদেশে আসছে। এসব ব্যাপারে সরকারের আরো সতর্ক হওয়া উচিত।

পাকিস্তান নিয়ে আর কী বলবো? রাজনীতির নামে সেখানে যা শুরু হয়েছে সেটি দেশটির রাজনীতি তথা সমগ্র দেশটিরই বারোটা বাজানোর উপক্রম করেছে। পাকিস্তানে এখন সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান। অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো তার দল পিটিআই বা তেহরিকে ইনসাফে পাকিস্তান। ৯ আগস্ট রাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সংবিধান মোতাবেক বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত হওয়ার মাত্র ৪ দিন আগে তোশাখানার একটি মামলা তাড়াহুড়ো করে শুনানী করে তাকে ৩ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। আর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ইমরানকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। যেভাবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং যেভাবে মুসলিম লীগ এবং পিপলস্ পার্টি সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল হয়েছে তার ফলে পাকিস্তানের রাজনীতি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পুরাতন খেলার শিকার হয়েছে। আর এই ধরণের অনভিপ্রেত খেলায় তাদের মুরব্বি যে আমেরিকা সেটি ইমরান খান তার অপসারণের কয়েক দিন আগে প্রকাশ্যে বলেছেন। ইমরান খান লক্ষ লক্ষ লোকের জনসভায় বলেছেন যে আমেরিকায় ডোনাল্ড লু সেখানে কর্মরত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ইমরান খানকে সরাতে হবে। শাহবাজ শরীফের সরকার ইমরানের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দেড় বছর পর আমেরিকারই একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ইমরান খানের অভিযোগের প্রতিধ্বনি করা হয়েছে। নিচে আমরা ওয়াশিংটনের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি তুলে দিলাম।

॥ তিন ॥
সংবাদটির শিরোনাম, “ডোনাল্ড লুর সঙ্গে পাকিস্তানি দূতের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান ইমরান।” পত্রিকাটির নাম হলো, ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’। সংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দুই কর্মকর্তার মধ্যে বৈঠকটি গত দেড় বছর ধরে পাকিস্তানে জল্পনা-কল্পনার শীর্ষে রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি তীব্র সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেয় পাকিস্তানকে। দ্য ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদন অনুসারে, ৫ আগস্ট ইমরানকে যখন দুর্নীতির অভিযোগে তিন বছরের কারাদ- দেওয়া হয় তখন থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। আদালত ঘোষিত সিদ্ধান্তে চলতি বছরের শেষদিকে পাকিস্তানে প্রত্যাশিত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না ক্রিকেট থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান। পাকিস্তান সরকারের নথি অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তাদের বৈঠকের এক মাস পর পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই ভোটেই ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ইমরানকে। এ ঘটনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
ইন্টারসেপ্ট বলছে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইমরান খানের বিরুদ্ধে তাদের নিয়মিত কৌশল প্রয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানি দূতকে জানানো হয়েছিল, ইমরানকে সরিয়ে দেওয়া হলে ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উষ্ণ সম্পর্ক থাকবে, নইলে পাকিস্তানকে একঘরে করে দেওয়া হবে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি বেনামী সূত্র ‘সিক্রেট’ শিরোনামের নথিটি দ্য ইন্টারসেপ্টকে সরবরাহ করেছে। এতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের বিবরণ রয়েছে। ৭ মার্চ হওয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং সে সময়ে দেশটিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসাদ মাজিদ খান। দ্য ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে ইমরান খানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনের বিষয়ে ইমরান খানের গৃহীত অবস্থান তার অপসারণের পর দ্রুত বদলে যায়।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে কূটনৈতিক বৈঠকটি ইউক্রেন সংঘাত শুরুর দুই সপ্তাহ পর হয়েছিল। তখন ইমরান খান মস্কো গিয়েছিলেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের রাশিয়া সফরটি ক্ষুব্ধ করে তোলে যুক্তরাষ্ট্রকে। ইন্টারসেপ্ট বলছে, ২০২২ সালের ২ মার্চ বৈঠকের কয়েক দিন আগে ইউক্রেন সংঘাতে পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশগুলোর নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির শুনানিতে লুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেনের প্রশ্নের জবাবে লু বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি মস্কো সফর করেছেন। এই সফরের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা কীভাবে যুক্ত হতে পারি, তা নিয়ে ভাবছি। বৈঠকের এক দিন আগে ইমরান খান জনসভায় দেওয়া ভাষণে দিয়ে বলেছিলেন, আমরা কি তোমাদের দাস? আপনারা আমাদের কী মনে করেন? আপনারা যা বলবেন আমরা তাই করব?

তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা রাশিয়ার বন্ধু। আমরা যুক্তরাষ্ট্রেরও বন্ধু। আমরা চীন ও ইউরোপেরও বন্ধু। আমরা কোনও জোটের অংশ নই। নথি অনুযায়ী, বৈঠকে লু রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে পাকিস্তানের অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অনাস্থা ভোটের বিষয়ে দ্য ইন্টারসেপ্ট ডোনাল্ড লুকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘আমি মনে করি যদি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট সফল হয় তবে ওয়াশিংটনে সবাইকে ক্ষমা করা হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরটিকে একটি সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।’
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://www.dailysangram.info/post/532518