১২ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১২:৪৮

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে কেন?

ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগী ৮০ হাজার ছাড়ালো ৩৭৩ জনের প্রাণহানি

দেশের ৬৪ জেলায় এখন ডেঙ্গুর থাবা। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। দিন দিন পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। গত কয়েকদিন রাজধানীর চেয়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় মশা মারার ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামে কিন্তু নেই। ফলে মশা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। গ্রামেও এখন অনেক নির্মাণকাজ হওয়ায় স্বচ্ছ পানি জমে থাকার সুযোগ রয়েছে। এসব জায়গায় এডিস মশা সহজে জন্মাতে পারে। তাই মশা নিয়ন্ত্রণ করাই এখন বড় ব্যাপার।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়লেও রাজধানীতে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে এ পরিস্থিতি আশ্বস্ত হওয়ার মতো নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আগস্ট থেকে নভেম্বর এই চার মাসেই ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। তারা বলছেন, সংক্রমণের উচ্চহার যদি এক জায়গায় থাকে তাকে রোগতাত্ত্বিকভাবে স্থিতিশীল বলা যাবে না। রোগী বেশি হলে মনে করতে হবে, সংক্রমণ চলমান আছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঢাকায় দিনে গড়ে এক হাজার ১০০-এর বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৫০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে।

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় মশা মারার ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামে তা নেই। ফলে মশা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। নগরায়ণের কারণেও এই মশা শহর থেকে গ্রামে চলে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে আক্রান্ত এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি হবে ভয়বাহ হবে। কারণ হাসপাতালগুলো সেভাবে প্রস্তুত নেই। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখী হচ্ছেন। এই জনস্বাস্থ্যবিদ জেলা ও বিভাগীয় শহরের বড় বড় হাসপাতালগুলোকে আরও সক্ষম করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত এই কয়েকটি বিষয়কে সিমুলেশন মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে থাকি। সেখানে আমরা এখনো কোনো স্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখছি না। আমাদের কাছে মনে হয় এখনো আশঙ্কার দিনগুলো রয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, জেলা ও মফস্বল শহরগুলোতেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বাড়ছে, এটি একটি কারণ। গ্রামাঞ্চলেও নানা ধরনের যানবাহন ব্যবহার হয়। এসব যানবাহনের পুরনো টায়ার যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। গ্রামেও এখন অনেক নির্মাণকাজ হওয়ায় স্বচ্ছ পানি জমে থাকার সুযোগ রয়েছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ এখন এত নিবিড়, ঢাকা থেকে একটা বাস যাচ্ছে কোনো না কোনো জেলা শহরে। এই বাসের সঙ্গে এডিস মশা চলে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এডিস মশা স্থায়ী হয়ে উঠছে। বংশ বিস্তার উপযোগী পরিবেশ পেয়ে প্রজনন করছে। সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সঙ্গে করে ভাইরাস নিয়ে যাচ্ছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, যদি সংক্রমণের উচ্চহার এক জায়গায় থাকে সেটাকে রোগতাত্ত্বিকভাবে স্থিতিশীল বলা যাবে না। বর্তমানে ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। যদি কমে গিয়ে স্থিতিশীল থাকে সেটা স্থিতিশীল। তিনি বলেন, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এ চার মাসেই ঝুঁকি রয়েছে। যখন আমরা দেখবো পর পর দুই সপ্তাহ ধরে কমে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বলা যাবে সংক্রমণ কমেছে। তবে সে অবস্থা এখনো আসেনি। ঢাকার বাইরে রোগী বাড়তে থাকায় বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন এই উপদেষ্টা। ঢাকার বাইরের এলাকাগুলো ভাইরাসের জন্য অবারিত ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠছে।

দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, পরিস্থিতি যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। রোগী বাড়লে মৃত্যুও বাড়তে পারে। মশা নিয়ন্ত্রণ করাই এখন বড় ব্যাপার।

ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগী ৮০ হাজার ছাড়ালো, ৩৭৩ প্রাণহানি: একদিনে আরও ৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আগস্টে মৃত্যুর সংখ্যা ১২২ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭৩ জনে। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুতে পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৪৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত ৩৭৩ জনের মধ্যে নারী ২১৩ জন এবং পুরুষ ১৬০ জন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৮৪ জন এবং রাজধানীতে ২৮৯ জন। তবে শুক্রবার ছুটি থাকায় সব হাসপাতাল ডেঙ্গুর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পাঠায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৪৬ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৫৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৯৩ জন।

নতুন ২ হাজার ৪৬ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬৭৫ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪ হাজার ৪২১ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ২৫৪ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৮০ হাজার ৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা মহানগরে ৪০ হাজার ৭৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩৯ হাজার ৩১০ জন। ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত ৫০ হাজার ২৮৯ জন এবং নারী ২৯ হাজার ৭৮৫ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭০ হাজার ২৬ জন। আগস্টের ১১ দিনে ২৮ হাজার ২৪২ জন শনাক্ত এবং প্রাণহানি ১২২ জনের।

https://mzamin.com/news.php?news=68982