১১ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৫০

বিরোধী দল, জনগণ ও পুলিশ

-মো: হারুন-অর-রশিদ

তারিখটি ২৮ জুলাই ২০২৩। ১৫ বছরের টানা নির্যাতন-নিপীড়ন, হামলা-মামলা, জেল-জুলুমের শিকার হয়েও ওই দিন বিএনপি প্রমাণ করেছে, তারাই দেশের বেশির ভাগ জনগণের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে সরকারের পদত্যাগÑ এক দফা দাবিতে নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত বিএনপির ওই সমাবেশে বিপুল মানুষ হাজির হয়েছিল। নয়াপল্টন থেকে শুরু করে পল্টন, সেগুনবাগিচা, রমনা পার্ক, মতিঝিল, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা, আরামবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, শাজাহানপুর, খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত স্লোগানমুখর শুধু মানুষের মাথাই দেখা গেছে। কত লোকের সমাবেশ ছিল হিসাব করে বলা মুশকিল।

বৈরী আবহাওয়া জনগণের মনে বৈরিতা সৃষ্টি করতে পারেনি; বরং আনন্দ-উল্লাসে স্লোগানে স্লোগানে আকাশের বৈরিতাও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। পথে পথে তল্লাশি, মোবাইল চেক করে গ্রেফতার, নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে হুমকি কোনো কাজে আসেনি। জনসমাগম ঠেকাতে সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো সরকারের এ কাজের জবাব দিতে আরো বেশি করে লোক এসেছে ঢাকা শহরে। মনে হচ্ছিল, পুরো দেশের জনগণ এই সরকারের পদত্যাগের দাবি নিয়ে ঢাকা শহরে হাজির হয়েছে। উপস্থিতি সরকারের পক্ষে হজম করা সম্ভব হয়নি। বদ হজম হয়েছে। যার প্রমাণ তারা পরের দিন দেখিয়েছে। বিগত এক বছর ধরে বিএনপি মাঠের আন্দোলনে পুরোপুরি সক্রিয় হয়েছে। বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। প্রতিটি সমাবেশে লাখো মানুষের জমায়েত হয়েছে। গ্রেফতার, নানা নির্যাতন এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা করা সত্ত্বেও দলটির আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। কোনো সমাবেশে বিশৃঙ্খলা হয়নি। এর পরও ২৯ জুলাই পুলিশ সরকারের হুকুম পালন করতে গিয়ে নিজেরা আওয়ামী লীগের কর্মীর ভূমিকা পালন করে। পুলিশ রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত বাহিনী। কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়। কিন্তু ২৯ জুলাই বিএনপি নেতাকর্মীদের দমনের অভিপ্রায় নিয়ে মারমুখী পুলিশ বিএনপি কর্মীদের ওপর যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে, তা দেখে মনে হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে যুদ্ধের ভাব নিয়ে পুলিশের হামলে পরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কতটুকু শোভনীয় ছিল তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলে। ওই ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চলমান বিক্ষোভে রাজনৈতিক সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ঘটনার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের আহ্বান জানিয়েছে। সেই সাথে প্রত্যাশা করেছে, দেশটিতে শান্তিপূর্ণ জমায়েত করে জনগণ যাতে তার উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে এমন পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে সরকারকেই।

এ ছাড়া প্রতিটি দলকে মৌলিক স্বাধীনতা ও আইনের শাসনকে সম্মান জানাতে হবে। সবরকম সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন থেকে দূরে থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। জাতিসঙ্ঘ থেকেও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে সব রাজনৈতিক দল, তাদের সমর্থক ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশন। সেই সাথে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও একই দিনে প্রায় একই রকম আরেকটি বিবৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের ও বিশে^র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মতে, বাংলাদেশে চরমভাবে মানবাধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে, তার সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে। এ অবস্থায় একটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা যেখানে সর্বাগ্রে সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী একটি সরকারের অধীনে কোনো অবস্থাতেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।

আজকে রাষ্ট্রকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে প্রতিটি রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সরকার পুলিশবাহিনীকে রাজনৈতিক বাহিনীতে পরিণত করে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর প্রতিশোধমূলক আচরণ করাচ্ছে। স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে পুলিশের ভূমিকাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক বিশে^র কাছে বিতর্কিত করছে। দুঃখজনক হচ্ছে, যারা জীবনবাজি রেখে, রক্ত দিয়ে দেশটিকে স্বাধীন করেছে, রাষ্ট্রশক্তি পুলিশবাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধেও বল প্রয়োগ করতে বাধ্য করছে। রাষ্ট্রশক্তির এটি কোনো সাধারণ অপরাধ নয়; গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের দায় রাষ্ট্রশক্তিকে নিতেই হবে। পুলিশবাহিনীকে ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রমূলক নাটকের আরো স্ক্রিপ্ট তৈরির চেষ্টা করছে সরকার। রাজপথে রক্তাক্ত করে, কাউকে হাসপাতালে পাঠিয়ে সেখানে ফল-মূলের ঝুড়ি পাঠানো হয়, আবার কাউকে হাসাপাতালে চিকিৎসা দিয়ে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে সোনারগাঁও হোটেলের খাবার খাইয়ে, তার আবার ছবি তুলে, ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে দলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। এই পলিসি সরকারের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের তাগিদে বিবেকের জাগ্রত হওয়া ভালো। কিন্তু সেই বিবেক যদি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিবেকের মতো হয় তাহলে তেমন বিবেক জাতির জন্য হবে ভয়ঙ্কর অশুভ। বিএনপি ও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে, সেই সংগ্রামের সহজ তাৎপর্য হলো, একটি নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সরকারের যদি বিবেক জাগ্রত হয়, তা হলে তেমন একটি নির্বাচন আয়োজন করতে তাদের এত ভয় কেন? তাদের ভয়ের ক্ষেত্রটি তারাই তৈরি করে রেখেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় গেছে, তারা জনগণের অধিকারকে লুণ্ঠন করার চেষ্টা করেছে। এখনো চেষ্টা করছে একটি একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে।


শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল ইতিহাসের পর ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরালে শেখ হাসিনা ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে একটি ম্যানেজড নির্বাচন। ২০১৪ সালে জনগণ ভোট দিতে যায়নি, সেটি ছিল এক ধরনের সিলেকশন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে ডাকাতি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এখন লেখা ও কথা বলার অধিকার হারিয়েছে বুদ্ধিজীবী মহল। এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে এই সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা চিন্তা করা বোকার স্বর্গে বসবাস করার শামিল।

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদে শুধু এই দেশের মানুষই জেগে ওঠেনি, জেগে উঠেছে বিশ^বিবেকও। যার কারণে জাতিসঙ্ঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব গণতান্ত্রিক বিশ^ এই সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লুণ্ঠনের চিত্র সামনে এনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। জনগণের ভোট হরণকারী একটি সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে ভারত নির্লজ্জের ভূমিকায় ছিল তারাও এখন এই দেশের জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলছে। রাশিয়া ও চীনে চলছে কর্তৃবাদী শাসকের শাসন। এই কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী চাইছে বাংলাদেশেও কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকুক। তাদের এই ইচ্ছা জনশক্তির কাছে বুমেরাং হয়ে যাবে, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করছে।

পুলিশের ভূমিকা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সাংবিধানিক সরকারের কাজ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতুড়ি, হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়ার কাজে পুলিশকে ব্যবহারের অর্থ হলো দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা। নির্বাচনী কাজেও তাদের আইনগত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কাজ করার অধিকার দেয়া মানে পুলিশকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো। আমাদের দুর্ভাগ্য, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় যাদের বেতন, পোশাক হয়; সেই পুলিশবাহিনীকে জনগণের অধিকার রক্ষার কাজে ব্যস্ত না রেখে, নাগরিক অধিকার লুণ্ঠিত করার কাজ করানো হয়। এর থেকে প্রহসন আর কী হতে পারে! মোদ্দা কথা, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে, জনগণ নিজেদের অধিকার হারাতে থাকবে এবং রাষ্ট্র ক্রমে আরো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
harun_980@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/768865