১১ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৪৮

আলাদিনের চেরাগ

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম অপরিচিত কোনো নাম নয়। শুরুর দিকে এরা বাসের ব্যবসা করেছে। তারপর একদিন দেখলাম এসএটিভি নামে তারা একটি টেলিভিশন সেন্টার খুলেছে। সে সেন্টারে চেনা মুখ সব সময় ঘুরে ফিরে আসেন। খোলার পর আমিও দু’একবার তাদের টকশোতে অংশ নিয়েছি। অনুজপ্রতীম বন্ধুবান্ধবরাই এই টিভির কর্মকর্তা। ঢাকা শহরের কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে এসএটিভির অফিস। আলোচকদের বলতে শুনেছি সাইফুল (এসএ) বেশ পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা সাধারণত সে টাকা শোধ করতে চান না। যখন এতে তারা ডিফল্টার হয়ে পড়েন তখন ব্যাংক থেকে আরো টাকা নেন।

ডিফল্টারের অংক আরো বাড়তে থাকে। এ সময় তারা আবার একটি কিস্তি জমা দিয়ে ঋণের উপর ঋণ নেন। কোলেটারাল বলতে কিছু থাকে না। একটা ভাঙ্গা ঘরের ভেতরে কিছু বাতিল যন্ত্রপাতি ফেলে রেখে সেটাকেই কোলেটারেল দেখাল। এভাবেই তারা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন।

তবে শুধুমাত্র একটি ব্যাংক থেকেই এই ঋণ গ্রহণ করেন না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তারা প্রায় একই কায়দায় ঋণ নিয়ে থাকেন। এই ঋণের টাকা কীভাবে যে কোন কায়দায় ডলার হয়ে বিদেশে উড়ে যায় সেটা কেউ কখনো জানতে পারে না। এভাবে এস আলম গ্রুপ লক্ষ কোটি ডলার পাচার করে দেন বিদেশে। এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যদিও বিদেশে বিনিয়োগ ও অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি বলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এ পর্যন্ত মোট সতেরটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিলেও চট্টগ্রামভিত্তিক এই বিশাল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নাম সেই তালিকায় নেই। কাগজপত্রে আরো দেখা যায় গত দশ বছরে সিঙ্গাপুরে এস আলমের অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য যে সম্পদ কিনেছেন সেখানেও বিভিন্ন উপায়ে কাগজপত্র থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী ২০২৩ সালের দশ জানুয়ারি পর্যন্ত চল্লিশ দশমিক পনেরো মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে বিনিয়োগের জন্য নেওযা হয়েছে। তবে এই পরিমাণ অর্থ ২০০৯ সালের পর সিঙ্গাপুরে এস আলমে কেবল দু’টি হোটেল ও একটি বাণিজ্যিক স্পেস কেনার চারশ এগারো দশমিক আট মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিতে আরো দেখা যায় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈধ উপায়ে সিঙ্গাপুরে এক লাখ সাত হাজার মার্কিন ডলার পাঠিয়েছে। যার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানও এস আলমের মালিকানাধীন নয়।

পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিংগাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি বলে ডেইলিস্টার জানিয়েছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিতে দেখা যায় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈধ উপায়ে সিংগাপুরে যে টাকা পাঠিয়েছে তার কোনো বৈধ উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এস আলমের বিনিয়োগ সর্ম্পকে জানতে ডেইলিস্টারের তরফ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিতবাবে যোগাযোগ করলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাতে কোনো সাড়া দেননি। বিদেশে বিনিয়োগ দাফতরিকভাবে কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। তারপরও কেন্দ্রয় ব্যাংক বিষয়টি সর্বোচ্চ গোপনীয় বিষয় হিসাবে দেখে বলে প্রতীয়মান হয়।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন এস আলম তাদের কাছ থেকে কখনো বিদেশে অর্থ নেওয়ার কোনো ধরনের অনুমতি নেননি। বাংলাদেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ বারো বছর কারাদ- এবং যে পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদ-।

সাইফুল আলম এসআলম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৮৫ সালে এবং তখন থেকেই এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। তার ব্যবসার পারিধি অন্য বাণিজ্য থেকে মাছ ধরা, নির্মাণসামগ্রী থেকে আবাসন ব্যবসা, টেক্সটাইল থেকে মিডিয়া, আন্তনগর বাস থেকে শিপিং এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ থেকে ব্যাংকিং বীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ বিষয়ে এস আলমের বক্তব্য জানার জন্য দুইবার তার কাছে লিখিত প্রশ্ন পাঠান। দুইবারই তিনি তার আইনজীবী এ. হোসেন অ্যান্ড এসোসিয়েটসের মাধ্যমে জানান যে, পুরো সংবাদ প্রতিবেদনটি তাকে না পাঠালে তিনি জবাব দেবেন না।

এস আলম ও তার স্ত্রী অফশোর বিজনেসের যে বিস্তৃত জাল বুনেছেন তার কিছু অংশ ডেইলি স্টারের কাছে থাকা নথি থেকে জানা গেছে। এস আলম ও তার স্ত্রীর সিঙ্গাপুর ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এবং সাইপ্রাসে বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ভূমধ্যসাগরীয় ছোট দেশ সাইপ্রাস। ২০০৭ সালে তাদের গোল্ডেন পাসপোর্ট কর্মসূচি চালু করে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা সংস্থার মতে এই প্রকল্পের আওতায় দেশটির আবাসন খাতে আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এবং সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে আরো দুই লাখ অনুদানের বিনিময়ে ধনী বিদেশীদের সাইপ্রাসের নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়া হয়। এর দুই বছর পর ২০০৯ সালে ২৭ আগস্ট সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী ফার্জানা পারভীন নিজেদের সাইপ্রাসের নাগরিক ও সিংগাপুরের বাসিন্দা দেখিয়ে সিংগাপুরে ক্যানালি লজিস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে কোম্পানিটির ইস্যু করা ও পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ছিলো বাইশ দশমিক চৌত্রিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এস আলম ও তার স্ত্রী একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। আলম ত্রিশ মিলিয়ন শেয়ারের ৭০ শতাংশ এবং তার স্ত্রী বাকি ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। সিংগাপুরে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটিতে রেসিডেন্স পারমিট বা বিদেশীদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।

বিশে^র বেশ কিছু বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সিংগাপুর থেকেই পরিচালিত হয়। যার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়িকগোষ্ঠীও রয়েছে। অনুসন্ধানি সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামে তৈরি অপশোরলিকস-এর ডাটাবেজ অনুযায়ী প্রাক ৬০০০ শেল কোম্পানি (নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান) সিংগাপুরের সাথে যুক্ত। এস আলম ও তার স্ত্রী ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের আরো একটি অপসর শেল কোম্পনির সঙ্গে যুক্ত। চুক্তির শর্ত পূরণ করে ক্যানালি ইতিমধ্যে প্রাথমিক আমানত ও ব্যালেন্স ডিপোজিটসহ চৌদ্দ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। সিংগাপুরের একটি লফার্ম এই চুক্তিতে হোটেলের প্রতিনিধিত্ব করে। হোটেলটি সিংগাপুরের লিটিল ইন্ডিয়ায় ১৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কেনা হয়। এতে রয়েছে ৩২৮টি কক্ষ।

হোটেলটির নাম ছিল গ্র্যান্ড চেঞ্জেলার হোটেল। তখন তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিলো ৩১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর বার্ষিক আয় ছিলো ৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরে এর নাম পাল্টে গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল প্রাইভেট লিমিটেড রাখা হয়। এখন সিংগাপুরের কেন্দ্রস্থলে হিলটন গার্ডেন ইন সিরাংগুনের ব্র্যান্ড নামে হোটেলটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
অধিগ্রহণের এক বছর পর ক্যানালি লজিস্টিক্স উইল কিংসন ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড নাম ধারণ করে। ২০২১ সালে যার সম্পদের মোট মূল্য প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিষ্ঠানটি যখন একের পর এক সম্পত্তি ক্রয় করছে তখন তার বার্ষিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী ছিলো। এস আলম নানান রকম কৌশল করে নিজের বদলে অন্যকে পরিচালক করে এসব ব্যবসা চালাতে থাকেন।

একই কা- তিনি করেছেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ, সবচেয়ে সফল ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে। লন্ডনের ইকোনোমিস্ট পত্রিকা রিপোর্ট করেছিলো যে এই ব্যাংক দখল করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এস আলমকে সহযোগিতা করেছিলো। তারপর একই কায়দায় বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এস আলম। একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই এস আলম গ্রুপ এক মাসে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

https://www.dailysangram.com/post/532320